সফল উদ্যোক্তা ৩ নারীর লড়াইয়ের গল্প

সন্তানদের স্কুলে আনা-নেওয়ার মাঝের সময়টাতে অনেক মাকেই বাইরে বসে গল্প-আড্ডায় সময় কাটাতে দেখা যায়। কিন্তু  আফরোজা খানম মিলির এভাবে সময় নষ্ট করা ভাল লাগতো না। কিছু একটা করার তাগিদ তাকে তাড়া করে বেড়াতো।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2020, 03:08 AM
Updated : 13 March 2020, 09:24 AM

একদিন একটি দোকানে গিয়ে কাঁথা বিক্রি করতে দেখে তার মনে হলো, এমন জিনিস তিনি সহজেই তৈরি করতে পারেন। অথচ বিক্রি হচ্ছে বেশ দামে। দোকানদারকে কাঁথা সরবরাহের প্রস্তাব দিয়ে বসলে দোকানি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন। ব্যস! শুরু হয়ে গেল উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা।

মাত্র তিন হাজার টাকার পুঁজি দিয়ে শুরু করে সাত বছরে ৫০ লাখ টাকা মূলধন গড়েছেন মোহাম্মদপুরের কাদিরাবাদের ‘হস্ত শৈলী’ নামে বুটিকসের মালিক ৩৫ বছর বয়সী এই নারী। তবে এটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে, ততটাই কঠিন ছিল তার জন্য। পরিবারের কঠিন সময়, যখন স্বামী ছিলেন বেকার, উদ্যোক্তা হওয়ার লড়াই শুরু করে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে।

তার মতো এমন অনেক নারীই সামান্য পুঁজি নিয়ে শুরু করে নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন। ক্ষুদ্র পুঁজি দিয়ে নিজের উপার্জন শুরু করে এখন শত শত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছেন বেকার নারীদের।

রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজম্যান্ট প্রাঙ্গণে সম্প্রতি শেষ হওয়া তিনদিনের ব্যাংকার-এসএমই মেলায় নিজেদের তৈরি পণ্যসম্ভার নিয়ে হাজির হয়েছিলেন এমন অনেক উদ্যোক্তা।

তাদের কয়েকজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে তুলে ধরেছেন, কীভাবে পরিবার এমনকি স্বামীর আপত্তির পরও নানা চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে তারা স্বাবলম্বী হয়েছ্নে এবং আরও নারীকে স্বাবলম্বী করতে প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানে সহযোগিতা করছেন।

‘অনার্স-মাস্টার্স করে এসব মানায় না’

২০১৩ সালে প্রথম কাঁথা তৈরি করে দোকানে সরবরাহ করার মধ্য দিয়ে উদ্যোগ শুরু করেছিলেন আফরোজা খানম মিলি। তখন তার ও স্বামী কারোরই চাকরি ছিল না। তবে কাঁথা তৈরি করলেও তা খুব সহজে বিক্রি করতে পারতেন না।

‘হস্ত শৈলী’র স্বত্ত্বাধিকারী আফরোজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আত্মীয়স্বজন সবাই সমালোচনা করেছে, কেউই চায়নি আমি উদ্যোক্তা হই। তাদের কথা হল, অনার্স-মাস্টার্স করে এসব করা মানায় না।”

কিন্তু সমালোচনা-নিন্দায় পাত্তা না দিয়ে ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকেন তিনি। কাঁথা তৈরির জন্য সস্তায় কাপড় কিনতে স্বামীকে ইসলামপুরে পাঠাতেন। তা দিয়ে কাঁথা তৈরি করে বিক্রি করতেন। এক পর্যায়ে মুনাফা থেকে আরও ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসার পরিসর বাড়ান তিনি। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন-বিসিক থেকে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণও নেন আফরোজা।

তিনি বলেন, “ময়মনসিংহ, গৌরীপুরে গেলাম কাঁথা বানিয়ে নেওয়ার জন্য। তেমন লাভ হল না। এরপর গেলাম জামালপুর। সেখান থেকে কাঁথা বানিয়ে আনলাম। কিন্তু এগুলো বিক্রি করা খুব কঠিন ছিল।”

পরে সেগুলো তার স্বামী ও গৃহকর্মী ফেরি করে মানুষের কাছে গিয়ে কাঁথাগুলো বিক্রি করেন বলে জানান তিনি।

২০১৫ সালের মাঝামাঝি বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষকরা মেলার আয়োজন করে সাবেক ছাত্রী আফরোজাকে সেখানে ডাকেন। তার অনীহা থাকলেও শিক্ষকদের অনুরোধে ৩৫ দিনের শিশুকে নিয়ে মেলায় অংশ নেন। কিন্তু সেখান থেকেই তার ভাগ্য ফিরল।

তিনি বলেন, “আমার বাচ্চা, কাজের মেয়ে নিয়ে মেলায় গিয়ে বসলাম। তখন তো আমার অতো প্রডাক্ট নাই, বাইরে থেকে নিলাম। খুব সাড়া পেলাম, তখন থেকেই সাহস বেড়ে গেল।”

আফরোজার ‘হস্ত শৈলী’ এখন ব্লক, বাটিক, হাতের কাজের শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, চদার, নকশি চাদর, সুতার কাজের ওয়ান পিসসহ নানা ধরনের পণ্য বিক্রি করছে।

আত্মীয়দের সমালোচনা থাকলেও তাদের সহযোগিতা পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “স্বামীর অনুপ্রেরণায়ই এগিয়ে যাওয়া আমার। তিনি সহযোগিতা করছেন সবসময়।”

ব্যবসার পরিধি বাড়াতে রূপালী ব্যাংকও তাকে ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করেছে।

৪০০ টাকার উদ্যোগ থেকে ৩৫ জনের কর্মসংস্থান

চারশো টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন রংপুরের ছাদেকুন নাহার; এখন তার প্রতিষ্ঠানে ৩০ থেকে ৩৫ জন কাজ করেন। উদ্যোক্তা হতে প্রধান বাধা ছিলেন তার স্বামী। কিন্তু তাতে দমে যাননি তিনি।

২০০৪ সালে ফ্রকের কুরুশকাটার কাজের মাধ্যমে বুটিকসের ব্যবসা শুরু করেন বর্ণালী বুটিকসের স্বত্তাধিকারী ৩৪ বছর বয়সী এই নারী। বাসায় টিউশনি করতেন তিনি। তার তৈরি শো-পিস ও সেলাইয়ের কাজ দেখে শিক্ষার্থীদের মায়েরা প্রশংসা করেন এবং সেগুলো বানিয়ে দিতে বলেন। এখান থেকেই যাত্রা শুরু এই উদ্যোক্তার।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রথম প্রথম সারা রাত জেগে কাজ করতাম, কারণ পণ্যগুলো তো ডেলিভারি দিতে হবে। কিন্তু যখন বেশি অর্ডার আসা শুরু হলো, তখন আর নিজের পক্ষে এতো কাজ করা সম্ভব হল না। আশপাশের কেউ কুরুশকাটার কাজ জানে কিনা খুঁজতে লাগলাম।

“একজন বলল, তিনি কিছুটা কাজ জানেন, তাকে আমি শিখিয়ে দিলাম। কারণ আমার তো ইচ্ছা ব্যবসা বাড়ানো। একা তো সব করা সম্ভব নয়। তাই প্রশিক্ষণ দিতে লাগলাম।”

২০১৭ সালে বিসিক নারী উদ্যোক্তা মেলায় রংপুর বিভাগ থেকে প্রথম হন তিনি। ওই বছর ব্যবসা বাড়াতে ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে ২ লাখ টাকা এসএমই ঋণ পান তিনি।

তার তৈরি হস্তপণ্য, বুটিক পণ্য রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- শিশুদের কুরুশ কাটার ফ্রক, কুশন কাভার, সোফার কাভার, বেতের ব্যাগ, পুতির শোপিস, ক্লিপ, অ্যাপ্লিকের চাদর, হাতের কাজের শাড়ি, পাটের দড়ি দিয়ে পাপোশ, চটের ব্যাগ ইত্যাদি।

রংপুরে তার শোরুম ছিল, তবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় কিছুদিন আগে তা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন বাসা থেকেই বিভিন্ন জায়গায় পণ্য বিক্রি করছেন। তিনি টিউশনি করান, সেখান থেকেই ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন।

ছাদেকুন বলেন, উদ্যোক্তা হতে তার পরিবার, স্বামী তার জন্য প্রধান বাধা ছিল।

“তারা চাইতো না আমি এসব করি। তবে আমার তিন সন্তান সবসময় অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য।”

ডিগ্রী পাশ ছাদেকুন নাহার হোমিওপ্যাথির ওপর কোর্সও করেছেন।

শখের সেলাইকর্ম থেকে উদ্যোক্তা-প্রশিক্ষক

ছোটবেলা থেকেই সেলাইয়ের কাজের প্রতি তীব্র ঝোঁক ছিল বরিশালের সানজিদা সালমা পলির। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে যায় তার। ব্যবসায়ী স্বামীর সংসার স্বচ্ছল হলেও নিজের কিছু করার তীব্র ইচ্ছা ছিল পলির। কিন্তু স্বামীসহ দুই পরিবার থেকেই ছিল বিরোধিতা।

এর মধ্যেই মানসিক চাপ মোকাবেলা করে ১৯৯২ সালে ছোট্ট পরিসরে কাজ শুরু করেন সানজিদা। তখন সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে তেমন কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। নিজের স্বল্প দক্ষতা আর তীব্র ইচ্ছাই সম্বল।

বরিশালের রূপাতলীতে ‘শিল্প কুটির’ তার শোরুম। শাড়ি, থ্রিপিস, জুতা-স্যান্ডেল, বাচ্চাদের পোশাক, হাতের কাজের আর্কষণীয় ব্যাগ, শোপিস, অলঙ্কার, কসমেটিকস, জন্মদিনসহ উৎসবের জন্য কেক ও নানা পদের ডের্জাট খাবার তৈরি করে তার প্রতিষ্ঠান।

সানজিদা বেকারি, উন্নত রান্না, যুব উন্নয়ন কতৃক বিউটি পার্লারে কাজ, সেলাই, ব্লক, বাটিক ইত্যাদি সকল টেইলারিং বিষয়ে প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকেন।

প্রায় ৪০ বছর বয়সী এই নারী বলেন, “শূন্য হাতে শুধু মেধা দিয়ে আমি কাজ শুরু করেছি। আমি প্রথমে নিজে করতাম। কিন্তু পরে দেখলাম, আমি একা করে তো লাভ নেই, তারপর থেকে আমি শেখানো শুরু করলাম।”

এখন তার ২৫ লাখ টাকার পুঁজি রয়েছে; এর মধ্যে ২০১২ সালে আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসার পরিধি বাড়ান। সারা বছরই দেশজুড়ে মেলায় অংশ নেন সানজিদা। এটা তার ব্যবসায়ী স্বামীর পছন্দ নয়।

সানজিদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নানাভাবে বুঝিয়ে আমাকে কাজটা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। বাবার বাড়ি, শ্বশুড়বাড়ি দু জায়গা থেকেই বাধা। আমি কেন মেলা করব? উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করব? আমার স্বামীর অভিযোগ, আমি মেলায় বসে আমার স্বামীকে হেয় করি।”

তার অধীনে কাজ করছেন ২১ জন কর্মী আর খণ্ডকালীন কাজ করছেন ২০ থেকে ২৫ জন। দ্ক্ষ কারিগর তৈরি করে কর্মসংস্থান তৈরি করতে চান তিনি।

“বেকার ছেলে-মেয়ে,অসহায়, দরিদ্র, বিধবা, প্রতিবন্ধীদের আমি বিনা খরচে ট্রেনিং করাই। কিন্তু যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের কাছ থেকে টাকা নেই।”

সমাজসেবা অধিদপ্তর, বিসিক, যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন এনজিওতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন এই নারী উদ্যোক্তা।