তারা বলছেন, এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ধারাবাহিকভাবে কমছে। সেখানে বিদ্যুতের দাম বাড়লে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। তখন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর নানা অনিয়ম, সিস্টেম লস ও অদক্ষতার কারণে যে ক্ষতি তা পোষাতে গ্রাহকের উপর বাড়তি দামের বোঝা চাপানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
“এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি কিংবা অন্য যে কোনো পর্যায়ে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কা সহ্য করার মতো সক্ষমতা পোশাক শিল্পের নেই।”
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয় ছিল ৪ হাজার ৫৩ কোটি ৫০ লাখ (৪০.৫৩ বিলিয়ন) ডলারের বেশি, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ১০ শতাংশ বেশি। এই আয়ের ৮৪ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে।
তবে চলতি অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি উল্টো পথে হাঁটছে। প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ২ হাজার ২৯২ কোটি ডলারের ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ২১ শতাংশ কম।
বৃহস্পতিবার খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের নতুন যে মূল্যহার ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে স্ল্যাব অনুযায়ী ক্ষুদ্র শিল্পে বিদ্যুৎ বিল ১৬ হাজার ৫৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৭ ৩৬০ টাকা, মাঝারি শিল্পের ৩ লাখ ২৬ হাজার টাকা থেকে ৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ও বৃহৎ শিল্পে এক কোটি ৬২ লাখ ৪০ হাজার টাকা থেকে এক কোটি ৭১ লাখ ৪০ হাজার টাকা হবে বলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসির চেয়ারম্যান একটি হিসাব দিয়েছেন।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পর পরই বিএনপি ও বামদলগুলোসহ বিভিন্ন অঙ্গন থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। মূল্য বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবি তুলেছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব।
বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়ে চাহিদার তুলনায় প্রবৃদ্ধি হওয়ার পরেও দাম না কমে উল্টো বাড়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন বেঙ্গল প্লাস্টিকস ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম কর্ণধার জসিম উদ্দিন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধি প্লাস্টিক শিল্পে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই মুহূর্তে ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটটা খানিকটা ‘ভোলাটাইল’। এর সঙ্গে যোগ হল বিদ্যুতের বাড়তি দাম। এখন উৎপাদনের খরচ বাড়বে, ফলে প্লাস্টিক পণ্যের দাম বেড়ে যাবে।
“আমরা পণ্যের মূল্য ও কোয়ালিটির ক্ষেত্রে বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় রয়েছি। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি সেই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেবে। কারণ উৎপাদন খরচ বাড়ার বিপরীতে বাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে না, বরং কমছে। আস্তে আস্তে বাংলাদেশ বিশ্ববাজার থেকে আউট হয়ে যাবে।”
বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর স্তরে স্তরে দুর্নীতির অভিযোগ করে আসছেন ভোক্তা নেতারা। বিষয়টি সরাসরি না উল্লেখ না করলেও কোম্পানির অনিয়ম, সিস্টেম লস ও অদক্ষতার প্রভাবে এ ধরনের মূল্য বৃদ্ধির ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের এই সাবেক সহ-সভাপতি।
“যখন আমাদের বিদ্যুৎ ছিল না, তখন বলা হতো উৎপাদন বাড়লে দাম ধীরে ধীরে কমে আসবে। অর্থনীতির হিসাবও তাই বলে। এখন আমাদের কনজাম্পশনের চেয়েও উৎপাদন সক্ষমতা বেশি। তার পরেও কেন দামটা বাড়ল? এই প্রশ্ন এখন খুবই প্রাসঙ্গিক।”
সরকার ‘কোয়ালিটি বিদ্যুৎ’ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূরণ না করেই কিছু দিন পর পর দাম বাড়িয়ে চলেছে মন্তব্য করেন এই উদ্যোক্তা।
“এখনও কোয়ালিটি বিদ্যুৎ নেই। উৎপাদন বাড়লেও বিতরণ লাইনগুলোর সক্ষমতা নেই। তাই বড় কারখানাগুলোতে লোডশেডিং ম্যানেজমেন্টের জন্য জেনারেটর চালাতে হচ্ছে।”
দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত চামড়া শিল্পের উদ্যোক্তা সমতা লেদার কমপ্লেক্সের নির্বাহী পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, এই শিল্পের উৎপাদন ব্যাপকহারে বিদ্যুৎনির্ভর। তাই নতুন করে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে এই খাতের উৎপাদন খরচও অনেক বেড়ে যাবে।
নিজের কারখানার চিত্র তুলে ধরে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা হিসাব করে দেখেছি, সব ধরনের চার্জ মিলিয়ে এতোদিন প্রতি ইউনিট ৮ টাকা ৫০ পয়সা হারে বিদ্যুতের বিল দিয়ে এসেছি। মাসে গড়ে চার লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা বিল দিতে হয়েছে। এখন এর সঙ্গে প্রায় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বর্ধিত মূল্য যোগ হচ্ছে।
“আমরা এর প্রভাব ক্যালকুলেশনের জন্য হিসাব-নিকাশ করছি।”