চীনে করোনাভাইরাসে দুশ্চিন্তায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা

বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকের অধিকাংশ কাঁচামাল আসে যে চীন থেকে, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সেখানে কারখানা ও মালের চালান বন্ধ থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Feb 2020, 06:58 PM
Updated : 19 Feb 2020, 07:38 PM

শুধু গার্মেন্ট কারখানা সচলের পণ্য নয়, ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রিক্যাল সামগ্রী, কৃষি যন্ত্রপাতি, মেশিনারিজ পণ্য, স্টিলের কাঁচামাল, রাসায়নিক, চশমা সামগ্রী, পাদুকা, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, পেঁয়াজ-রসুন-আদা, মাল্টা, আপেল, কমলাসহ অন্যান্য পণ্য আসে চীন থেকে।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রভাবে চীনের বড় শহরগুলো অচল হয়ে পড়ার আগেই দেশটিতে উৎসবের অন্যতম প্রধান উপলক্ষ নতুন চান্দ্রবর্ষ সামনে রেখে কারখানা বন্ধ হয়েছিল। ওই ছুটি শেষ হওয়ার পর কারখানা খুললেও শ্রমিকের অভাবে এখনও উৎপাদনে যেতে পারছে না তারা, আবার অনেক কোম্পানির খোঁজ এখনও মিলছে না বলে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন।

আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে চীনের রপ্তানিকারকরা আশ্বাস দিলেও তাতে পুরোপুরি ভরসা করতে পারছেন না বাংলাদেশিরা।

চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, চীনে পরিস্থিতির উন্নতি হলে আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি গতিতে বন্দরের কার্যক্রম চালিয়ে ক্ষতি পোষানো হবে।

তারা আশ্বাস দিলেও দিন দিন গার্মেন্ট মালিকদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মশিউল আজম সজল।

তিনি বুধবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই কয় দিনে সাপ্লাই চেইন মারাত্মক বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং এটা দিন দিন বাড়ছে। এই পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। তবে দিন দিন কারখানা মালিকদের মাথায় দুশ্চিন্তা ভর করছে।

“কারণ একদিকে কার্যাদেশ কমছে, অন্যদিকে কাঁচামালের জোগান কমছে। এই অবস্থায় বায়ারদের সঙ্গে কোনো দর কষাকষি তো দূরে থাক, কার্যাদেশও নেওয়া যাচ্ছে না। এখনই চীনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এর ধাক্কা আগামী এপ্রিল-মে মাস পর্যপ্ত পড়তে পারে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে এক লাখ ১৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে, যা ওই বছরের মোট আমদানির ২৬ শতাংশ। 

পোশাক ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, পোশাক খাতের ৩৭টি থেকে ৪০টি কাঁচামালের অধিকাংশ পণ্যই আমদানি করা হয় চীন থেকে। বিভিন্ন ধরনের সুতা, ফেব্রিক্স, জিপার, বোতাম রয়েছে এর মধ্যে।

এসব পণ্যের বিকল্প বাজার থাকলেও আমদানিকারকরা এখনই চীনের বিকল্প হিসাবে অন্য দেশকে বেছে নিতে চাচ্ছেন না।

বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৯২ শতাংশই আসে পোশাক খাত থেকে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়েছে এই খাত।

চীনের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিজিএমইএ নেতা মশিউল আজম সজল বলেন, “সেখানে কিছু কিছু অফিস চালু হয়েছে। কিন্তু কারখানাগুলো চালু হয়নি। সেখানে ৬০ শতাংশ শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হতে পারেনি। কখন যে এই অবস্থার উন্নতি হবে সেটা কেউ বলতে পারছে না।”

ফেইম স্যুয়েটারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সজল জানান, চীন থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ থাকায় ইতোমধ্যেই দেশের মধ্যে অনেক কারখানায় ৩-৪টি করে লাইন অচল হয়ে গেছে।

“এই পরিস্থিতি যদি আরও বাড়তে থাকে তাহলে ব্যাপক বেকারত্বের সৃষ্টি হবে। কারণ শত শত শ্রমিককে বসিয়ে রেখে বেতন দেওয়া কোনো কারখানার পক্ষে সম্ভব নয়।”

বাংলাদেশ যে ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছে প্রতিযোগী ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান কিংবা তুরস্ক তার চেয়ে একটু সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বলে মন্তব্য করেন এই গার্মেন্ট ব্যবসায়ী।

তিনি বলেন, পাকিস্তানের ‘ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের’ নিজস্ব সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। আর ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় সড়ক পথে ট্রাকযোগে পণ্য চলে আসে চীন থেকে। বাংলাদেশে সরাসরি জাহাজ আসতেও ১৫ দিন সময় প্রয়োজন, সাধারণত জাহাজগুলো আসতে ২৫ থেকে ৩০ দিন সময় নিয়ে থাকে।

বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পের ‘ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ’ খাতে যুক্ত আছে ১৬০০ থেকে ১৭০০ কোম্পানি। এদের সবাই চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে নিজস্ব সক্ষমতা যোগ করে গার্মেন্টের বোতাম, জিপার, রংসহ অন্যান্য কাঁচামাল তৈরি করে।

এরকম প্রতিষ্ঠান ওশান এক্সেসরিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর আব্দুস সাত্তার মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চীনে করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে পোশাক শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের পণ্যের ওপর। এই খাতে মোটামুটি ৩৭টির মতো পণ্য রয়েছে, যার ৩৪টি আসে সরাসরি চীন থেকে। প্যাকেজিংয়ের জন্য কার্টন, পলিব্যাগসহ মাত্র ৪-৫টি পণ্যের কাঁচামাল আসে চীনের বাইরের দেশ থেকে। এক্সেসরিজের ৮ থেকে ১০টি পণ্যের দাম ইতোমধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়ে গেছে।”

সঙ্কট নিয়ে তিনি বলেন, “অধিকাংশ গার্মেন্টে এক থেকে দেড় মাসের যোগান থাকে। তাই এখনই সঙ্কট দৃশ্যমান না হলেও মার্চ-এপ্রিল মাসে বড় ধরনের সমস্যার বিষয়টি সবাই আশঙ্কা করছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে চীনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এই সঙ্কটের আশঙ্কা রয়েছে। আর চীনের পরিস্থিতি আরও দীর্ঘ হলে সঙ্কটও দীর্ঘ হবে।”

আরেক কোম্পানি ‘কনভিন্স জিপার’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাফেজ আলম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চীনের করোনাভাইরাসের মূল ধাক্কাটা লাগবে আগামী মাসে। চীনে বন্দরগুলো চালু হলেও সেখানে একটা জ্যাম লেগে যেতে পারে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই কিছু কিছু কারখানায় সঙ্কট দেখা দিয়েছে। চীন থেকে কবে রপ্তানি শুরু হবে তা ৪-৫ দিন যাওয়ার আগে বলা যাবে না।”

বাংলাদেশের চশমার বাজারের একটি বড় অংশ রয়েছে চীনের দখলে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম মূল্যের কারণে চীনের বাইরে গিয়ে চশমা আমদানি করেন না বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ চশমা শিল্প বণিক সমিতির সভাপতি সানাউল্লাহ খান বলেন, “চশমা একটি অতি জরুরি পণ্য এবং এর ৯৫ শতাংশ চীন নির্ভর।

“জানুয়ারির ১০ তারিখ থেকে আমদানি বন্ধ রয়েছে। আমরা প্রতিদিনই যোগাযোগের চেষ্টা করছি। কবে যে চালু হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। চীনের গোয়াংঝু ও সাংহাই থেকে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বেশি লেনদেন করে।”

চশমার বাজারে এখনও বড় ধরনর প্রভাব না পড়লেও আগামী দুই-তিন মাসে সঙ্কট হবে বলে আশঙ্কা করেন সানাউল্লাহ।

“একটি অর্ডার দেওয়ার পর ওই পণ্য উৎপাদন হতে দুই মাস সময় লেগে যায়। সেটা শিপমেন্টে সময় লাগে আরও এক মাস। সব কিছু মিলিয়ে চশমা আমদানি সচল হতে আরও চার মাস সময় লেগে যেতে পারে।”

তিনি বলেন, “চীনের অনেক কোম্পানি চশমার অর্ডার চাচ্ছে। কিন্তু আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, তাদের কর্মচারীগুলো এখনও কারখানায় আসেনি। অনিশ্চয়তার কারণে অনেকে অর্ডার দিচ্ছেন না। আবার অনেক কোম্পানিকে যোগাযোগ করেও পাওয়া যাচ্ছে না।”

পুরান ঢাকার নবাবপুরের শিফাং মেশিন হাউজের নাসির উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে ইলেক্ট্রনিক মোটর পাম্পের পুরো বাজারই বলা যায় চীনের দখলে। তবে দুই-এক মাস আমদানি বন্ধ থাকলেও এই খাতে ‘সমস্যা হবে না’।

বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল মোটর পাম্প ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি শহীদুল ইসলাম স্বপন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দেশের সব ধরনের ছোট বড় মেশিন, পানির পাম্প, ইলেকট্রিক মোটরসহ মেশিনারিজ যন্ত্রপাতি চীনের বাজার নির্ভর। এক মাস আমদানি বন্ধ থাকলে এসব পণ্যে ‘প্রভাব পড়ার কথা নয়’। তবে বিয়ারিং জাতীয় পণ্য বেশি দিন মজুদ রাখা যায় না বিধায় এর সঙ্কট দেখা দিতে পারে।

“চীনে নববর্ষের ছুটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের আমদানিকারকরা কিছু পণ্যের মজুদ করেছিল। সে কারণে এখনও মজুদ আছে। নবাবপুরে এখনও কোনো পণ্যের দাম বাড়ে নাই। তবে আর সর্বোচ্চ আর ১৫ দিন চলবে। মার্চের শেষ দিকে বড় আকারে প্রভাব পড়বে।”

চীনের মেশিনারিজ পণ্য ঘিরে নবাবপুরে বছরে ‘২৫ হাজার কোটি টাকার’ লেনদেন হয় জানিয়ে শহীদুল বলেন, এই বাজারে চীনের কোনো বিকল্প নেই। দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা তাইওয়ান এত কম দামে এ ধরনের পণ্যগুলো উৎপাদন করতে পারে না।

চীনের যে হুবেই রাজ্যে করোনাভাইরাসের আক্রমণ, সেখানেই কারখানার অধিকাংশ শ্রমিকও বলে ধারণা দেন স্বপন।

ব্যাটারি উৎপাদনকারী আব্দুল্লাহ ব্যাটারির মালিক এটিএম মোস্তফা বলেন, ব্যাটারি তৈরির অধিকাংশ কাঁচামাল দেশে পর্যাপ্ত রয়েছে। তবে ব্যাটারির জন্য প্রয়োজনীয় প্লাস্টিক দানাসহ বলা যায় ১০ শতাংশ পণ্যের জন্য চীনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

“আগামী এক মাসের মধ্যে সমস্যার সমাধান হলে এই খাতে প্রভাব পড়বে না। এর চেয়ে বেশি দীর্ঘায়িত হলে বিকল্প বাজার খুঁজতে হবে।”

ফ্রেশ ফ্রুট ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ শামসুল হক বলেন, চীন থেকে নাশপাতি, কমলা, আপেল, আঙ্গুর আমদানি হয়ে থাকে। তবে এসব পণ্যের প্রতিটিরই বিকল্প বাজার রয়েছে। ফলে করোনাভাইরাসের কারণে দেশের ফলের বাজারে খুব একটা প্রভাব পড়বে না। ফলের বিকল্প বাজার ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, তিউনিসিয়া, নিউ জিল্যান্ড রয়েছে।

রাজধানীর শ্যামবাজারে আদা-রসুনের আমদানিকারক আব্দুল মাজেদ জানান, দেশে আদা-রসুনের বড় একটা জোগান আসে চীন থেকে। তবে এসব পণ্যের বিকল্প বাজারও রয়েছে।

“তাই এ নিয়ে সঙ্কট হওয়ার কোনা আশঙ্কা নেই। তাছাড়া দেশেই পর্যাপ্ত রসুন উৎপাদিত হয়।”