বিয়ের মওসুমে সোনার বাজারে হা-পিত্যেশ

বাংলাদেশে শীতকে বলা হয় বিয়ের মৌসুম, আর বছরের এ সময়টাই গয়না বিক্রেতাদের জন্য সবচেয়ে সু সময়। কিন্তু সোনার বাজারে এবার নিরানন্দ ভাব।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Jan 2020, 04:33 PM
Updated : 13 Jan 2020, 06:45 PM

জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের সারা বছরের বিক্রির একটি বড় অংশ হয় ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে, মানে বিয়ের মওসুমে। কিন্তু এবার বেচাবিক্রি তাদের প্রত্যাশার অর্ধেকও পূরণ করতে পারবে বলে তারা মনে করতে পারছেন না। 

সমস্যা কোথায়? সমস্যা সোনার দামে। বাংলাদেশে এখন ২২ ক্যারেটের ভালো মানের সোনার দাম ৬০ হাজার ৩৬১ টাকা, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বিয়ের বাজার ধরতে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) গত অক্টোবরে প্রতি ভরি (২২ ক্যারেট) সোনার দাম ৫৬ হাজার ৮৬২ টাকায় নামিয়ে এনেছিল। কিন্তু এরপর চার ধাপে সেই দাম ৬০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর সেজন্য মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকে দায়ী করছেন বাংলাদেশের গয়না ব্যবসায়ীরা।    

বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, “ইরান-যুক্তরাষ্ট্র টেনশনের কারণে সাম্প্রতিক এই মূল্য বৃদ্ধি। সামনে বাজার কোন দিকে যাবে এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা আশায় থাকব, ক্রেতারা নতুন দামে অভ্যস্ত হয়ে আবার বাজারে ফিরে আসবেন।”

বায়তুল মোকাররম, নিউ মার্কেট, চাঁদনি চক, বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক, ইস্টার্ন প্লাজাসহ বড় বড় শপিং মল ও অভিজাত বিপণি বিতানগুলো রাজধানীতে গয়নার বড় বাজার।

রোববার বায়তুল মোকাররম ও নিউ মার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা গেল, ক্রেতার অভাবে গয়নার দোকানের কর্মীরা অলস সময় কাটাচ্ছেন।

আমিন জুয়েলার্স, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, সুলতানা জুয়েলার্সসহ পরিচিত ব্র্যান্ডের দোকানে দুয়েকজন ক্রেতা থাকলেও বাকি দোকানগুলো প্রায় ফাঁকা। 

নিউ মার্কেটে সুলতানা জুয়েলার্সের ব্যবস্থাপক সৈয়দ মনির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত এক মাসে দেখতে দেখতে সোনার দাম অনেক বেড়ে গেল। বেচাকেনা নেই বললেই চলে। এই মন্দাভাব কবে দূর হবে বলা মুশকিল।

আর শিল্পী জুয়েলার্সের বিপণনকর্মী বিপ্লব দে বললেন, “দিনে একজন কি দুজন ক্রেতা পাওয়াও এখন কষ্টকর হয়ে গেছে। দাম বেড়েছে জেনেও বিয়ের কারণে যারা আসছেন, তারা বেশি পরিচিত দোকানগুলোতেই যাচ্ছেন। পরিস্থিতি বেশ বাজে।”

নিউ মার্কেট এলাকায় ২৪ বছর ধরে গয়নার ব্যবসায় যুক্ত আছেন মাধুরী জুয়েলার্সের নন্দ বাবু। তিনি বলছেন, বিয়েতে উপহার হিসাবে সোনার অলঙ্কার দেওয়ার প্রবণতা এখন অনেকটাই কমে গেছে।

“বিয়েতে যা না হলেই নয় কেবল সে ধরনের কেনাকাটাই হচ্ছে এখন। যারা বিয়েতে ৫ ভরি বা ৭ ভরি স্বর্ণ কেনার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, তারা এখন ২/১ ভরি কাটছাঁট করছেন।”

অলঙ্কার বিক্রেতা নন্দ বাবুর কথার সুরই পাওয়া গেল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আল আমিনের কথায়।

গত ১০ জানুয়ারি বিয়ে করেছেন আমিন। কিন্তু লাফিয়ে বাড়া স্বর্ণের দাম তার বাজেট এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। 

“বিয়ের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা যখন চলে, তখন শুনলাম বিয়ের মওসুম উপলক্ষে স্বর্ণের দাম কমছে। কিন্তু বাজারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতেই দাম বেড়ে গেল প্রায় চার হাজার টাকা। গয়না কিনতে আমার ধারণার চেয়ে প্রায় ২১ হাজার টাকা বেশি গুণতে হয়েছে। দাম না বাড়লে এই টাকা দিয়ে আরেকটা অলঙ্কার পাওয়া যেত।”

আমিন বাজেটের চেয়ে বেশি খরচ করলেও সবার পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। তারা কমিয়ে দিচ্ছেন সোনার পরিমাণ। ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা আকতার হোসেন তন্বয়কেও তাই করতে হয়েছে।

“অগাস্টের শুরুতে সোনার ভরি ছিল ৫৩ হাজার টাকার চেয়ে একটু বেশি। তখন আমার এক আত্মীয় হিসাব করে ১২ আনা ওজনের কানের দুল কিনতে দিয়েছিলেন। ডিসেম্বরে বাড়ি যাওয়ার সময় কিনতে গিয়ে দেখি আরও চার হাজার টাকা প্রয়োজন। পরে বাধ্য হয়ে ওজন কিছুটা কমিয়ে ওই দুল কিনতে হয়েছে।”

আমিন জুয়েলার্সের শাখা ব্যবস্থাপক ইউনুস আলী খানও বললেন, তাদের বিক্রি ‘একেবারেই’ কমে গেছে।

“যাদের ১০ ভরি কেনার পরিকল্পনা ছিল, তারা এখন ৬/৭ ভরিতেই বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করছে।”

দাম বাড়লেও লাভ নেই?

সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় জুয়েলার্সদের স্টকে থাকা কম দামে কেনা সোনা এখন বেশি দামে বিক্রি করার সুযোগ এসেছে। সাধারণ হিসেবে তাতে তাদের লাভের অংক বাড়ার কথা। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়ায় সেই লাভ আর তাদের থাকছে না। 

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোনার বাজার একটি অনিশ্চিত বাজার। দামের ওঠানামা এই বাজারের জন্য খুবই অস্বস্তিকর। দাম বাড়লেও সেটা ব্যবসায়ীদের স্বস্তি দেয় না, কারণ প্রতিদিন যে পরিমাণ সোনা বিক্রি হয় বাজার থেকে ঠিক সে পরিমাণ সোনা কিনেই স্টক ঠিক রাখতে হয়।

“ফলে ব্যবসায়ীরা সরাসরি দাম বৃদ্ধির সুফল নাও পেতে পারেন। উল্টো বিক্রি কমে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাবটাই ব্যবসাকে প্রভাবিত করে।”

দাম বৃদ্ধির আরেকটি নেতিবাচক প্রভাবের কথা বললেন আমিন জুয়েলার্সের কর্মকর্তা ইউনুস আলী।

“বিয়ের মওসুম সামনে রেখে অগাস্ট- সেপ্টেম্বরে অনেকে বায়না করে রেখেছিলেন। এখন বাজারে দাম বাড়লেও বুকিংয়ের দামেই তাদের অলঙ্কার দিতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে হেরফের করার সুযোগ নেই।”

শুল্ক বাধা দূর হয়নি

সরকার স্বর্ণ নীতিমাল-২০১৮ ঘোষণা করার পর চলতি বছরে নিজেদের কাছে সঞ্চিত সোনা বৈধ করেছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে ডিসেম্বরের শুরুতে একটি ব্যাংকসহ ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে স্বর্ণ আমদানির লাইসেন্সও দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু শুল্ক বাধার কারণে এখনও কোনো লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান স্বর্ণ আমদানি শুরু করতে পারেননি বলে জানালেন দিলীপ আগরওয়ালা।

তিনি জানান, একজন যাত্রী এখন সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম সোনার গয়না বিনা শুল্কে আনতে পারেন। আর শুল্ক দিয়ে সর্বোচ্চ ২৩৪ গ্রাম বা ২০ ভরি সোনার বার আনা যায়। সেক্ষেত্রে প্রতি ভরিতে শুল্ক দিতে হয় ২ হাজার টাকা।

“অথচ লাইসেন্সধারী একজন ব্যবসায়ী যখন আমদানি করবেন, তখন প্রতি ভরিতে ওই দুই হাজার টাকা শুল্কের বাইরে আরও ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম বাণিজ্য শুল্ক (এটিভি) দিতে হবে। আমরা ভ্যাট ও অতিরিক্ত শুল্ক কমিয়ে সর্ব সাকুল্যে ভরিপ্রতি এক হাজার টাকা শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু এখনও কোনো সাড়া পাইনি।”

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে এনবিআরের ভ্যাট পলিসি বিভাগের সদস্য গোলাম কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কাছে প্রতিদিনই বিভিন্ন রকম চিঠি আসছে। বাজুসের চিঠিতো নজরে আসেনি। চিঠি এলে পরে চিন্তা করা যাবে।”