শ্রমিক অভিবাসন কমলেও প্রবাসে নারীকর্মী বেড়েছে

চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে বাংলাদেশ থেকে মোট শ্রমিক অভিবাসন কমলেও নারী শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়ার হার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2019, 12:41 PM
Updated : 29 Dec 2019, 12:56 PM

বাংলাদেশ থেকে শ্রম অভিবাসনের গতি-প্রকৃতি নিয়ে রোববার রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস ইউনিটের (রামরু) এক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৬ লাখ ৪ হাজার ৬০ জন বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে গেছেন, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৯৬২ জন।

অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে ৮০ হাজার ৯০২ জন কম শ্রমিকের অভিবাসন হয়েছে চলতি বছরের ১১ মাসে।

অন্যদিকে চলতি বছরের ১১ মাসে ৯৭ হাজার ৪৩০ জন নারী শ্রমিক বিদেশে গিয়েছেন, যা আগের একই সময়ে ছিল ৯১ হাজার ৯২১ জন।

অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে পাঁচ হাজার ৫০৯ জন বেশি নারী শ্রমিক এবার বিদেশ গেছেন।

রামরুর সভাপতি অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, চলতি বছরের ১১ মাসে বিদেশে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে কমলেও রেমিটেন্সের পরিমাণ বেড়েছে।

২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৬ লাখ ৪ হাজার ৬০ জন বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে গেছেন এবং এসময়ে দেশে রেমিটেন্স এসেছে ১৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার।

এর বিপরীতে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ কর্মী বিদেশে গিয়েছেন, যে সময়ে ১৫ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল।

শ্রমিক অভিবাসন ও রেমিটেন্স প্রবাহের চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে গত বছরের চেয়ে প্রবাসী কর্মীর সংখ্যা ১০ শতাংশ কমে যাবে। কিন্তু বিপরীতে রেমিটেন্সের পরিমাণ গত বছরের চেয়ে ১৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ বলে মনে করছেন রামরু সভাপতি।

রেমিটেন্স পাঠানোর ক্ষেত্রে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহে বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রণোদনার সিদ্ধান্ত কার্যকরের পর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৭৭৪ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে, যেখানে আগের ছয় মাসে আসে ৮৯২ কোটি ডলার।

রামরু সভাপতি বলেন, প্রবাসে নারী কর্মীদের নিগ্রহের ঘটনা বড় আকারে প্রকাশ পেলেও চলতি বছর তাদের বিদেশে যাওয়ার সংখ্যা বেড়েছে।

এবছর নভেম্বর পর্যন্ত ৯৭ হাজার ৪৩০ জন নারী কর্মী বিদেশে গিয়েছেন।২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৯১ হাজার ৯২১ নারী শ্রমিক বিদেশে গিয়েছিল, যা গত বছরের ১১ মাসের তুলনায় পাঁচ হাজার ৫০৯ জন বেশি।

প্রবাসে নারী শ্রমিকদের যাওয়ার চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি বছরে এ সংখ্যা আগের চেয়ে ৪ শতাংশ বাড়বে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক।

গত বছরের ১২ মাসে একলাখ এক হাজার ৬৯৫ নারী শ্রমিক বিদেশে যান।

তিনি জানান, নারী শ্রমিকদের অভিবাসনের ক্ষেত্রে সৌদি আরবই বাংলাদেশের প্রধান গন্তব্য। গত ১১ মাসে দেশটিতে ৫৮ হাজার ২৮৩ জন নারী কর্মীর অভিবাসন হয়েছে, যা মোট নারী অভিবাসীর ৫৯ দশমিক ৮২ শতাংশ।

এর বাইরে নভেম্বর পর্যন্ত ১৮ হাজার ১২৩ জন নারী কর্মী জর্ডানে ও ১১ হাজার ৩২৩ জন নারী কর্মী ওমানে পাড়ি জমিয়েছেন। এই তিন দেশ মিলে ৯০ শতাংশ নারী কর্মীর গন্তব্য।

কয়েক বছর আগে সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিক পাঠানো শুরুর পর থেকে দেশটিতে গৃহকর্তার হাতে নানা ধরনের নির্যাতনের খবর আসতে থাকে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তাতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল না।

এ বছর জানুয়ারি থেকে অগাস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৮৫০ জন নারী দেশে ফিরে আসার পর তাদের মুখে সেখানে যৌন নিপীড়নসহ নানা ধরনের নির্যাতনের খবর গণমাধ্যমে আসার পর বিভিন্ন নারী সংগঠন সরব হয়।

রক্ষণশীল দেশটিতে নারী কর্মী না পাঠানোর দাবি উঠেছে জোরেশোরে ওঠার পর সম্প্রতি জাতীয় সংসদে আলোচনায় বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য সৌদি আরবে আর কোনো নারী গৃহকর্মী না পাঠানোর দাবি তোলেন।

বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে সৌদি আরব থেকে আনুমানিক তিন হাজার নারী কর্মী এবং ২১ হাজার পুরুষ কর্মী দেশে ফেরত এসেছে বলে জানান অধ্যাপক তাসনীম।

সৌদি আরবে নারী কর্মীদের সুরক্ষায় সরকারি ও নাগরিক সমাজের সমন্বিত তৎপরতা জোরদারের সুপারিশ করে রামরু সভাপতি বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে আরো দায়বদ্ধ করার পাশাপাশি বিদেশে সেইফ হোম ও স্থানীয় আদালতে মামলার সুযোগ সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

”সিভিল সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৎপর হতে হবে। নিগ্রহের কেইস স্টাডি তৈরি করে তাদের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক ফোরামে তুলে ধরার ব্যবস্থা বাড়াতে হবে।”

প্রবাসীকর্মীর উৎস আর গন্তব্য

প্রতিবারের মতো চলতি বছরও সবচেয়ে বেশি কর্মী সৌদি আরবে গিয়েছে বলে জানিয়েছে রামরু।

সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি জানান, ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সেদেশে ৩ লাখ ৬০ হাজার ২৪ জন কর্মী গিয়েছেন, যা এ বছরের মোট প্রেরিত কর্মীর প্রায় ৬০ শতাংশ।

শ্রম গ্রহণকারী দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে ওমান (১১.৬৮%), সেখানে গিয়েছে ৬৭ হাজার ১৭৭ কর্মী। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে আছে কাতার (৮.০৭%) ও সিঙ্গাপুর (৭.৫৮%)।

শ্রমবাজার বিস্তৃত করার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক তাসনীম বলেন, “অন্যান্য বছরগুলোর মত এবছরেও দেখা যাচ্ছে, গ্রহণকারী রাষ্ট্র তালিকায় একটি কি দুটি দেশের আধিপত্য। এক কি দুই দেশ কেন্দ্রিক বাজার ব্যবস্থার অসুবিধা হলো সেই দেশ কোনো সমস্যা বা বিপর্যয়ের মুখোমুখি পড়লে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারও বিপদের মুখে পড়ে যায়।”

পূববর্তী বছরের ন্যায় ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত কুমিল্লা জেলা থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ বিদেশে গিয়েছে বলে তিনি জানান।

এই জেলা থেকে চলতি বছর প্রবাসে গিয়েছে ৫৩ হাজার ৯১১ জন কর্মী, যা মোট সংখ্যার ৮ দশমিক ৯২ শতাংশ।

দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বিদেশে গিয়েছে ৩৪ হাজার ১৪৯ জন, যা মোট সংখ্যার শতকরা ৫ দশমিক ৬৫ ভাগ।

টাঙ্গাইলকে সরিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আসা চট্টগ্রাম জেলা বিদেশে কর্মী পাঠিয়েছে ২৯ হাজার ২৭০ জন, যা মোট সংখ্যার ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

অন্যদিকে টাঙ্গাইল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কর্মী গিয়েছে ২৮ হাজার ৩৩৯ জন, যা মোট সংখ্যার শতকরা ৪ দশমিক ৬৯ ভাগ।