মানবিক মূল্যবোধ কোথায়: পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের মন্ত্রী

বিদেশ থেকে ৪০-৪২ টাকায় পেঁয়াজ এনে তা কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করায় ক্ষুব্ধ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ওই ব্যবসায়ীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের জাগরণ প্রত্যাশা করেছেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Dec 2019, 10:42 AM
Updated : 3 Dec 2019, 10:42 AM

সংকট মোকাবেলায় পেঁয়াজ আমদানিতে যাওয়া ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের পেঁয়াজ বাজারে ঢুকতে শুরু করেছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, আগামী ৪০ দিনের মধ্যে এক লাখ টন পেঁয়াজ বাজারে আসবে।

পেঁয়াজে কোনো মুনাফা না করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া এই প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানি খরচের যে হিসাব দিয়েছে, তাতে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের ব্যয় ৪২ টাকা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।

মঙ্গলবার রাজধানীর ফারস হোটেলে ‘নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধকল্পে ব্যবসায়ী সমাজের করণীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় এসব বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

তিনি বলেন, “গতকাল সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দরকার হলে আমাগী ৪০ দিনের মধ্যে এক লক্ষ টন পেঁয়াজ আমি ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে নিয়ে আসব। গত ছয় দিন ধরে মিশর ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ ঢুকতে শুরু করেছে। সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ-তারা বলেছে ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টন মাল দেবে। সবচেয়ে আনন্দের কথা তারা বলেছে, তারা এক টাকাও প্রফিট করবে না। যত কোটি টাকা লাগে ইনভেস্ট করবে।

“গত তিন দিন ধরে তারা টিসিবিকে যা দিয়েছে সেটা সর্বমূল্যে খরচ পড়েছে সাড়ে ৪২ টাকা। সেই দামের কস্ট প্রাইসের কাগজ পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে। তবে সমস্যাটা হয়েছে এই পরিমাণ যথেষ্ট নয় আমাদের বাজার সার্ভ করার জন্য। আমাদের আরও পেঁয়াজ দরকার।”

যৌক্তিক লাভ রেখে বাজারে পেঁয়াজ ছাড়তে ব্যবসায়ীদের মানবিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রী বলেন, “সিটি বা মেঘনা গ্রুপ যে পেঁয়াজ দিচ্ছে, এর বাইরেও কিছু কিছু পেঁয়াজ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ঢুকছে। তার মূল্যও কিন্তু কোনো অবস্থায় ৪০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারা তো বিক্রি করছে বেশি, আপনাদের সেই মানবিক মুল্যবোধটা কোথায়?

“একটাই পথ সেটি হচ্ছে যথেষ্ট পরিমাণে আমদানি করে এই ধরনের মুনাফা লোভী; যারা দুর্ভিক্ষের সামনে, ক্রাইসিসের সামনেও নিজেদের মূল্যবোধকে জাগ্রত করে না, তারা ব্যবসায়ী হতে পারে না। দেশের মানুষকে অভুক্ত রেখে, ক্রাইসিসে রেখে আপনারা প্রফিট করেন সমস্যা নাই, লজিক্যাল প্রফিট করেন। ৫ টাকা লাভ রেখে বাজারে পেঁয়াজ ছাড়েন। এরপরও বাজারে পেঁয়াজের কেজি ৫০-৫৫ টাকা হবে।”

ঢাকার বাজারে দেশি পেঁয়াজের পাশাপাশি মিশর, তুরস্ক, চীন ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। দেশি পেঁয়াজের কেজি আড়াইশ টাকার আশপাশে, আর এসব পেঁয়াজের কোনোটাই দেড়শ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না।

পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদের আরও সুযোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, “২৯ সেপ্টেম্বর যখন ভারত পেঁয়াজ বন্ধ করে দিল, সেদিন সন্ধ্যার সময়ে ঢাকার বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কথা নয়। পেঁয়াজ তো তখন স্টকে ছিল, কোনো কোনো ব্যবসায়ী সাথে সাথে সেই সুযোগটা নিয়ে নিয়েছে।

“আমাকে বহুবার বলা হয়েছে জেলে দেন, ক্রসফায়ারে দেন। কোথাও বলেছে, বাণিজ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই। আমার এক সেকেন্ডও লাগবে না পদত্যাগ করতে। কোনো সমস্যা নাই আমার। তাতে দেশের সবকিছু বিশেষ করে পেঁয়াজের দাম যদি ঠিক যেত, তাহলে আমার তো কিছু যায় আসে না। এই মন্ত্রিত্ব কাজ করার জন্য, জব করার জন্য।”

আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ কমিটির এই সভায় ভবিষ্যতে পেঁয়াজ সংকট সমাধানে আগামী তিন বছরের মধ্যে এই পণ্য উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পরিকল্পনা জানান টিপু মুনশি।

তিনি বলেন, “এই সমস্যা পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি আমাদের ওভারকাম হতে হলে আমাদের আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। এছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকব, আর ভারত যখন খুশি বন্ধ করে দেবে, তাহলে আমরা কীভাবে পেঁয়াজের বাজার ঠিক রাখব?

“উপায় একটাই, আমাদের এই পণ্য উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। সেদিন আমি এবং প্রধানমন্ত্রী বসেছিলাম, পেঁয়াজ নিয়ে কথা হচ্ছিল...তিনি বলেছেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে আমাদের যেভাবে হোক আত্মনির্ভরশীল হতেই হবে।”

এবার সরকারের ‘শিক্ষা হয়েছে’ জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রী বলেন, “ক্রাইসিস আমাদের আছে, তবে এই ক্রাইসিস সব সময় থাকবে না। পেঁয়াজ ডাবল-ট্রিপল দামে কিনে আমরা মরে যাব না। আমাদের শিক্ষা হয়েছে, কথায় আছে, কখনও কখনও বিপদ সম্পদে রূপান্তর হয়। ক্রাইসিস আমরা ফেস করব, ওভারকামও করব।” 

পেঁয়াজ চাষীরা যাতে ন্যায্যমূল্য পান সেজন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান মন্ত্রী।

তিনি বলেন, “একটাই পথ- আমাদের উৎপাদক, কৃষক যেন দামটা পায়। কারও মুখের দিকে তাকাতে হবে না, তারা চ্যাম্পিয়ন পিপল। তারা যখন পেঁয়াজ উঠায় ১০ থেকে ১৫ টাকা পায়। সেই সময়ে আমরা যদি তাদের ৩০ টাকা দিতে পারি, এই দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে। আমাদের ১০ টাকায় পেঁয়াজ খাওয়াতে হবে- ইটস নট লজিকাল।

“আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবার যখন পেঁয়াজ উঠবে আমি কোনো ধরনের আমদানি করতে দেব না। আমার উৎপাদকদের দাম পেতে হবে। তারা যদি ভালো দাম পায় তাহলে কারও দরকার হবে না। তিন বছরে ইনশাল্লাহ আত্মনির্ভরশীল হব। প্রয়োজনে আমরা ভারতে রপ্তানি করব।”

সাংবাদিকদের দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল এবং ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করার আহ্বান জানান বাণিজ্যমন্ত্রী।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য, শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ কমিটির চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সূচনা বক্তব্য দেন সদস্য সচিব আব্দুস ছাত্তার। মতবিনিময় সভার প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক।