পেট্রোল পাম্পে ধর্মঘটের পেছনে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব

পেট্রোল পাম্প মালিকদের সংগঠনের নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের জের ধরেই দেশের একাংশজুড়ে দুই দিনের ধর্মঘট পালিত হয়েছে বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Dec 2019, 07:09 PM
Updated : 2 Dec 2019, 07:09 PM

তেল বিক্রির কমিশন বাড়ানোসহ ১৫ দফা দাবিতে বাংলাদেশ পেট্রোল পাম্প ও ট্যাংক লরি মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ ও জ্বালানি তেল পরিবেশক সমিতির ব্যানারে গত রোববার সকাল থেকে কর্মবিরতি শুরু হয়।

সোমবার বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, বিপিসির ঢাকা লিয়াজোঁ অফিসে দুই ঘণ্টার বৈঠক শেষে ধর্মঘট স্থগিতের ঘোষণা আসে।

সাধারণ পেট্রোল পাম্প মালিকদের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় সংগঠনে নির্বাচন না হওয়ায় নেতৃত্ব নিয়ে এক ধরনের বিরোধ রয়েছে। তার জের ধরে কর্মবিরতির কর্মসূচি এসেছে।

ঢাকার মহাখালীর ক্লিন ফুয়েল স্টেশনের জিএম সরোয়ার আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পেট্রোল পাম্প মালিকদের কেন্দ্রীয় একটি সংগঠনের পাশাপাশি বিভাগীয় পর্যায়ে শাখা সমিতি রয়েছে।

“দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় সংগঠনে নির্বাচন না হওয়ায় নেতৃত্ব নিয়ে সারাদেশে এক ধরনের বিরোধ দেখা দিয়েছে। এই বিরোধের জের ধরেই পৃথক আন্দোলন।”

তবে সাধারণ পাম্প মালিকরা এই দাবিগুলোকে যৌক্তিক বলে মনে করে বলে জানান তিনি।

বৈঠকে থাকা বিপিসির পরিচালন বিভাগের পরিচালক সরোয়ার আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা ধর্মঘট ডেকেছে তারা একটা বিচ্ছিন্ন গ্রুপ। তাদের ঢাকা গ্রুপ, বগুড়া গ্রুপ, উত্তরবঙ্গ গ্রুপ রয়েছে।

“তাদের কেউ কেউ নেতাগিরি দেখানোর জন্য এমনটি করছে বলে আমাদের মনে হয়। তাদের নেতৃত্বের সঙ্কট রয়েছে।”

ধর্মঘট আহ্বানকারীদের মধ্যে সৈয়দ সাজ্জাদুল করিম পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং মিজানুর রহমান রতন নিজেকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দেন।

সরকারের সঙ্গে বৈঠকে পেট্রোল পাম্প ও ট্যাংক লরি মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি এম এ মোমিন দুলাল, পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, খুলনা বিভাগের সহ-সভাপতি এম মাহবুবুল আলম, সিনিয়র সহ সভাপতি মোহাম্মদ সোবহান আব্দুল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক শেখ মুরাদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

তবে মোহাম্মদ নাজমুল হক নামের একজন পেট্রোল পাম্প মালিক নিজেকে পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ‘বৈধ’ সভাপতি বলে দাবি করছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিভিন্ন অপকর্মের দায়ে বহিষ্কৃত কিছু নেতা পাম্প মালিকদের চলমান আন্দোলনে ব্যাঘাত সৃষ্টি ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলার উদ্দেশ্যে এধরনের কর্মসূচিতে গেছে।

“যেই দাবি নিয়ে তারা আন্দোলন করেছে, তার অধিকাংশই আমাদের কাছ থেকে কপি করা। নিজেরা যেগুলো যোগ করেছে, সেগুলো নিছক হাস্যকর। দাবিগুলোর অধিকাংশই আমরা আগেই করে আসছিলাম এবং এনিয়ে সরকারের সঙ্গে দেন-দরবারও চলছিল।”

দাবিগুলোর মধ্যে কমিশন বৃদ্ধিসহ আরও কয়েকটি দাবির যৌক্তিকতা থাকলেও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ট্রেড লাইসেন্স না নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার দাবি একেবারেই ‘হাস্যকর’ বলে মন্তব্য করেন নাজমুল।

“ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তরের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে লাইসেন্স না নিয়ে কীভাবে ব্যবসা করা যায়?”

এদিকে নাজমুলের বিরুদ্ধে ‘স্বেচ্ছাচার’র অভিযোগ করেন সৈয়দ সাজ্জাদুল করিম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজ ১২ বছর ধরে এই সংগঠনের কোনো নির্বাচনের আয়োজন করছেন না নাজমুল। তিনি একাই সর্বেসর্বা হয়ে বসে আছেন। সরকার এই সংগঠনে প্রশাসক নিয়োগ দিলেও তিনি আদালত থেকে স্থগিতাদেশ এনে সেই প্রশাসককে সরিয়েছেন। ফলে পাম্প মালিকরা বাধ্য হয়ে নিজেদের প্রয়োজনে কর্মসূচি দিয়েছে।”

দেশের একাংশে কেন এই কর্মসূচি- জানতে চাইলে সাজ্জাদ বলেন, “আমরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি। সারাদেশ অচল করতে চাইনি। সারাদেশের সমর্থন আমাদের সঙ্গে আছে।”

ধর্মঘট আহ্বানাকারী সাজ্জাদ ‘তেল পাচারের দায়ে’ সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন নাজমুল।

তিনি বলেন, “২০০৫ সালে ভারতে তেলের দাম বাংলাদেশ থেকেও ১৫ টাকা বেশি ছিল। সেই সময় ভারতে তেল পাচারের কাজে যুক্ত হয়েছিলেন সাজ্জাদ। এর পরে অনেক কিছু হয়েছে। তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এখন যারা আন্দোলন করছে তাদের অনেককেই বিভিন্ন অপরাধে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।”

নির্বাচন না দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে নাজমুল বলেন, “মাত্র ৫ মাস আগে এই সংগঠনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।”

বিপিসির পরিচালন বিভাগের পরিচালক সরোয়ার আলম বলেন, পাম্প মালিকদের একটি অংশের সঙ্গে আলোচনার মধ্যেই ধর্মঘটের কর্মসূচি আসে।

“তাদের কেন্দ্রীয় গ্রুপ আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দাবিগুলোর বিষয়ে আলোচনাও এগিয়ে চলছিল। হয়ত এমনি এমনি এগুলো বাস্তবায়ন হত। এর মধ্যে তারা হঠাৎ করেই ধর্মঘট ডেকে বসে।”

ধর্মঘটীরা যে দাবিগুলো তুলেছে, তার অধিকাংশই বিপিসির সঙ্গে সম্পর্কিত নয় বলে জানান সরোয়ার।

তিনি বলেন, “কোনটা সড়ক ও জনপথ বিভাগের সঙ্গে, কোনোটা বিস্ফোরক অধিদপ্তরের সঙ্গে, কোনোটা পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে।”

“ওদের অনেকগুলো সমস্যা আছে। আমাদের সাথে সমস্যা হলো পেট্রোলের কমিশন নিয়ে। সেটা এমনিতেই বাস্তবায়নের পর্যায়ে রয়েছে। চলতি বছরের প্রথম দিকে আলোচনায় বেশ কিছু দাবি পূরণও হয়েছিল, তাদেরকে সেই কথাটি জানিয়েও দেওয়া হয়েছিল,” বলেন সরোয়ার।