তাজরীন ট্রাজেডি: ক্ষতিপূরণের আশায় আশায় ৭ বছর

তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের সাত বছরেও কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি বলে এই ঘটনায় আহত শ্রমিকদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন; কর্মক্ষমতা হারিয়ে বেকার জীবনযাপনে নিজেদের চিকিৎসার ব্যয় বহনে অপারগ যাদের অনেকেই।

তাবারুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Oct 2019, 02:20 PM
Updated : 18 Oct 2019, 05:13 PM

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে সাভারের আশুলিয়ায় নিশ্চিন্তপুরে তোবা গ্রুপের মালিকানাধীন তাজরীন ফ্যাশনসে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়; দুই শতাধিক শ্রমিক আহত ও দগ্ধ হন।

আহতদের কয়েকজন শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ক্ষতিপূরণের দাবিতে মানববন্ধনে দাঁড়ান, যাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

ঘটনার দিন আগুন থেকে বাঁচতে তিনতলা থেকে লাফ দিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন ময়মনসিংহের জরিনা। অনেকের আশ্বাস, বহু জায়গায় কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরও কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি তিনি।

দুই সন্তানের জননী এই নারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার মেরুদণ্ড ভাঙ্গা। ঘাড় নাড়াতে পারি না। কোনো কাজকর্ম আমি করতে পারি না। কেবল স্বামীর রোজগারে সংসার চলা বড় দায়।

“এর মধ্যে আমার চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। কিন্তু অভাবের কারণে চিকিৎসা নিতে পারি না।”

সাত বছর ধরে ক্ষতিপূরণের আশায় থাকা রেহেনা বেগম বলেন, “আহত হওয়ার পর নারী ও শিশু হাসপাতালে বেশ কয়েক মাস চিকিৎসা নিয়েছি। তখন তো আমার কোনো টাকা-পয়সা লাগেনি।

“এখনও শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যাথা করে। মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছি। কিছুদিন পর পর হাসপাতালে যেতে হয়, কিন্তু চিকিৎসার জন্য ব্যয় করার মত কোনো অর্থ আমার নেই।”

তাজরীন ফ্যাশনসে ঝাড়ুদারের কাজ করতেন রংপুরের আঞ্জু আরা।

সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতিচারণ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি ছিলাম পাঁচতলায়, দেখি সবাই দৌড়াদৌড়ি-কান্নাকাটি করছে। আমিও দৌড়ে কিনারে এসে লাফ দিয়ে দোতলায় পড়ি।

“এতে পায়ের ভেতরে রড ঢুকে যায়। হাতপায়ে প্রচণ্ড আঘাত পাই। এরপর বহুদিন কয়েকটি হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিয়েছি। খরচ চালাতে বাবার সম্পত্তি থেকে পাওয়া তিন শতক জমি বিক্রি করেছি।”

এখন বিনা চিকিৎসায় আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “সরকার টাকা-পয়সার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো কিছুই পাইনি।”

বিভিন্ন  সময় শ্রমিক সংগঠনগুলো ‘ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষকেই ছাড় দিতে নারাজ’ বলে আসলেও এখন পর্যন্ত আহত শ্রমিকদের অভিযোগের সুরাহা হয়নি।

‘কিছু টাকা-পয়সা’ পাওয়ার আশায় এদিন আতাহারুল ইসলামও যোগ দেন মানববন্ধনে। স্ত্রী সাহেরা বাবু ঘটনার দিন বেঁচে ফিরে আসতে পারলেও মাথায় প্রচণ্ড আঘাতের কারণে এখন অনেকটা ‘অপ্রকৃতস্থ’ বলে জানান তিনি।

আতাহার বলেন, তাজরীন ফ্যাশনসের পেছনে একটি টিনের ঘরে তারা থাকেন। ঘর থেকে তার স্ত্রীর বের হওয়ার মত অবস্থা নেই। মাঝে মাঝে ঘরের লোকদেরও চিনতে পারে না।

সাহেরা ও আতাহারের সংসারে আছে শিশু দুই ছেলে ও এক মেয়ে। আতাহার একটি গার্মেন্টে কাজ করছেন। তবে একার আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে।

“স্ত্রী অনেকটা পাগলের মত। তার চিকিৎসা দরকার, কিন্তু অভাবের কারণে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি না।”

প্রেস ক্লাবের সামনে তাজরীন ফ্যাশনসের আহত শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণে দাবিতে মানবন্ধনের আয়োজন করে জাগো বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন।

সংগঠনটির আহ্বায়ক বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, “তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সাত বছর হতে চলছে। এ সময়ের মধ্যে বহু এনজিও আহত শ্রমিকদের নিয়ে অনেক খেলেছে।

“সেই ঘটনার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিহত ও আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে বলে বলেছিলেন। আহতদের মধ্যে মাত্র ১৭৪ জন সামান্য অংকের টাকা পয়সা পেয়েছে। এখনও শত শত আহত শ্রমিক কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি।”

এবিষয়ে জানতে চাইলে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে হতাহত শ্রমিকদের আইএলও কনভেনশন অনুসারে ক্ষতিপূরণের দাবি করেছিলাম আমরা।

“কিন্তু সরকার মাত্র কয়েকজনকে ৫/৬ লাখ টাকা করে দিয়েছে। আর অন্যান্য যারা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন তা খুব সামান্য।”

তিনি বলেন, আইএলও কনভেনশন অনুসারে একজন শ্রমিক তার কর্মক্ষতা থাকা অবস্থায় যে বেতন-ভাতা পাওয়ার কথা সেই অর্থ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা রয়েছে বলে জানান জলি। আর শ্রম আইনে আহত প্রতি শ্রমিক দুই লাখ টাকা করে পাওয়ার কথা বলা আছে।

অগ্নিকাণ্ডের ওই ঘটনার পর শ্রমিকদের  অভিযোগ ছিল, আগুন লাগার পরও কারখানার ছয়টি ফ্লোরের কয়েকটিতে দরজা আটকে রাখা হয়েছিল, শ্রমিকদের নিচে নামতে দেওয়া হয়নি।

এছাড়া ওই কারখানা নির্মাণের ক্ষেত্রে ইমারত বিধি অনুসরণ না করা এবং অবহেলারও প্রমাণ পাওয়া যায়।

এসব অভিযোগে তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী মাহমুদাসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। তদন্ত করে ১৩ মাস পর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির পরিদর্শক এ কে এম মহসীন উজ জামান খান।

অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৪ (ক) ধারা অনুযায়ী ‘অপরাধজনক নরহত্যা’ ও ‘অবহেলার কারণে মৃত্যুর’ অভিযোগ আনা হয়।

মামলার অপর আসামিরা হলেন- প্রতিষ্ঠানটির লোডার শামীম, স্টোর ইনচার্জ (সুতা) আল আমিন, সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল আমিন, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, অ্যাডমিন অফিসার দুলাল উদ্দিন, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনোয়ারুল, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জুর ও শহীদুজ্জামান দুলাল।

২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারক। এরপর শুনানি বিভিন্ন তারিখে সাক্ষী আনতে ব্যর্থ হয় রাষ্ট্রপক্ষ। মামলার কার্যক্রম একপ্রকার থেমে আছে বলা যায়।