দাম আরও বাড়তে পারে, এই আশঙ্কায় বেশি করে পেঁয়াজ কিনে রাখছেন অনেকে। মজুদ বাড়াচ্ছেন মহল্লার খুচরা দোকানিরাও। আর এই হুজুগে পেঁয়াজের বাজার হয়ে উঠেছে নিয়ন্ত্রণহীন।
পেঁয়াজের ‘সন্তোষজনক’ মজুদ থাকার কথা জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সবাইকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে। সারা দেশে ৭৫টি ট্রাকে পেঁয়াজ বিক্রির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে টিসিবিকে।
কেউ বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বাণিজ্য সচিব মো. জাফর উদ্দীন। কিন্তু তাতে অস্থিরতা কমেনি।
রোববার বিকালে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার পর ঢাকার বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ ৭৫ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল।
২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সোমবার বিকালে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে সব ধরনের পেঁয়াজের দাম কেজিতে আরও অন্তত ২০ টাকা বাড়তি দেখা যায়।
দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বছরে ১৭ থেকে ১৯ লাখ টনের মত। চাহিদা পূরণ না হওয়ায় আমদানি করতে হয় ৭ থেকে ১১ লাখ মেট্রিক টন। স্বল্প দূরত্ব ও সহজলভ্যতার কারণে বেশিরভাগটা ভারত থেকে আসে।
কিন্তু বৃষ্টি ও বন্যায় এবার পেঁয়াজের ফলন মার খাওয়ায় ভারত সরকার গত ১৩ সেপ্টেম্বর প্রতি টন পেঁয়াজের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য ৮৫০ ডলারে বেঁধে দেয়। ওই খবরে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম এক লাফে বেড়ে যায় ২০ থেকে ২৫ টাকা।
এরপর রোববার ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধের ঘোষণা দিলে ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
আড়তদার আর পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, দামের সঙ্গে সঙ্গে পেঁয়াজের বিক্রিও বেড়েছে; খুচরা ব্যবসায়ীরা যতটা পারা যায় কিনে রাখছেন।
মিরপুরের শাহ আলী বোগদাদিয়া বাণিজ্যালয়ের পরিচালক মোস্তফা কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার আড়ত থেকে এমনিতে প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ বস্তা পেঁয়াজ বিক্রি হয়। রবি আর সোমবার গড়ে একশ বস্তা করে বিক্রি হয়েছে।
“দাম বাড়ার পেছনে কারণ তো সবার জানা। পাড়া মহল্লার ব্যবসায়ীরা চাচ্ছেন পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই যেন তাদের কাছে বিক্রি করার মত কিছু পেঁয়াজ থাকে। তাই ক্রেতা বেড়ে গেছে।”
একদিনে এভাবে দাম বৃদ্ধির কী যৌক্তিকতা থাকতে প্রশ্ন করলে এই পাইকার বলেন, “ভারতীয় পেঁয়াজ কিছু নির্দিষ্ট ব্যবসায়ীর হাত হয়ে আড়তে আসে। তারা যে দাম ঠিক করে, সেই দামেই কিনতে হয়। তার ওপর এক টাকা থেকে দেড় টাকার হিস্যা যোগ হয় আড়তে। সে কারণে দাম বৃদ্ধির এই প্রক্রিয়ায় আড়তের ভূমিকা মুখ্য নয়।”
মিরপুরের আড়তগুলোতে এদিন ভারতীয় পেঁয়াজের তুলনায় পাবনা, ফরিদপুর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের পেঁয়াজের মজুদ ছিল বেশি। মিয়ানমার থেকে সম্প্রতি কিছু পেঁয়াজ দেশের বাজারে এলেও মিরপুরে তা চোখে পড়েনি।
দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে এ বাজরের শ্রীরাম ভাণ্ডারের পরিচালক কানাই লাল সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার শেষ সময়ের বৃষ্টিতে অনেক পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। তাছাড়া সারা বছর কৃষক পেঁয়াজের দাম খুব বেশি পাননি। এখন মওসুমের শেষ সময়ে দাম কিছুটা বাড়ায় কৃষকরা উপকৃত হবে।”
খুচরায় ১১০
রাজধানীর বড়বাগ ও কারওয়ান বাজারের খুচরা দোকানগুলোতে এদিন প্রতি কেজি ভালো মানের দেশি পেঁয়াজ ১১০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়, যা আগের দিনও ৯০ টাকা ছিল।
ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল ৯০ টাকায়। দেশি পেঁয়াজের দামই তুলনামূলক বেশি বেড়েছে বলে বিক্রেতারা জানালেন।
দাম দেখে ক্ষুব্ধ একজন ক্রেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “সরকার শুধু একের পর এক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা শোনাচ্ছে, কিন্তু বাজারে এর প্রভাব পড়ছে না। যত সঙ্কটই হোক, একটি পণ্যের দাম এক দিনের ব্যবধানে ২০ থেকে ২৫ টাকা কীভাবে বাড়ে? ব্যবসায়ীরা অবশ্যেই সুযোগ নিচ্ছে, সরকার তা ধরতে পারছে না।”
বড়বাগের মীম অ্যান্ড প্রান্তিকা জেনারেল স্টোরের পরিচালক নাজমুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে একশ টাকার বেশি দিয়ে। তাই ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন।
মিয়ানমারের ‘পচা’ পেঁয়াজ
বাণিজ্য সচিব মো. জাফর উদ্দীন সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সামনে দাবি করেন, এই মুহূর্তে দেশে পেঁয়াজের মজুদ ‘সন্তোষজনক’ পর্যায়ে রয়েছে এবং দাম নিয়ে ‘উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই’।
মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ নিয়ে দুটি জাহাজ ইতোমধ্যে বন্দরে ভিড়েছে জানিয়ে বাণিজ্য সচিব বলেন, “অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি জাহাজের পেঁয়াজ গতকাল খালাস হয়েছে। আর একটি জাহাজ আজ খালাস হবে। এছাড়া তুরস্ক ও মিশর থেকে পেঁয়াজ আনার প্রক্রিয়া চলমান।”
কিন্তু মিয়ানমার থেকে আসা পেঁয়াজের চালানে প্রচুর পরিমাণে পচা ও নষ্ট পেঁয়াজ পাওয়া গেছে বলে জানালেন ঢাকার শ্যামবাজারের আমদানিকারক আব্দুল মজিদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মিয়ানমারের পেঁয়াজের এই লোকসানের প্রভাব বাজারে পড়তে বাধ্য।”
শ্যাম বাজারের পাইকরি বিক্রেতা ইমাম ট্রেডার্সের ইদ্রিস আলী বলেন, চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজের সরবরাহ অনেক কম। ফলে সরবরাহকারীরা দাম বাড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে।
“ভারতীয় পেঁয়াজ আসছে না বললেই চলে। যাদের আগের মজুদ ছিল, তারা ৮৫ টাকায় বিক্রি করছে। দেশীয় পেঁয়াজের সরবরাহও অনেক কম। যেখানে ১০ ট্রাক পেঁয়াজ প্রয়োজন, সেখানে মিয়ানমারের পেঁয়াজ আসছে মাত্র দুই ট্রাক।”
ভারত থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ আসত মূলত সাতক্ষীরার ভোমরা আর দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে। কিন্তু দুই সপ্তাহ আগে ভারত পেঁয়াজের দাম তিনগুণ বাড়িয়ে দিলে হিলির ব্যবসায়ীরা নতুন করে এলসি খোলা বন্ধ করে দেন। তবে আগের এলসির পেঁয়াজ তখনও আসছিল।
ভারত সরকার নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সে দেশের কাস্টমস কর্মকর্তারা রোববার বিকাল ৪টার পর পেঁয়াজের চালান পাঠানো পুরোপুরি বন্ধ করে দেন বলে হিলির আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ী গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ জানান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, আগের এলসির বিপরীতেও কোনো পেঁয়াজ রপ্তানির অনুমতি দিচ্ছে না ভারতের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
হিলির বাজারে সোমবার ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হতে দেখা যায়। দুই সপ্তাহ আগেও দাম ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা।
চট্টগ্রামে ‘যেমন খুশি’ দাম
ভারত রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার পর চট্টগ্রামের পাইকারী ও খুচরা বাজারে যে যেমন খুশি দাম নিচ্ছে বলে ক্রেতাদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রামের বৃহত্তম পাইকারী বাজার খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। আর সোমবার সন্ধ্যায় খুচরা বাজার ও পাড়ার দোকানে ১০০ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হতে দেখা গেছে।
অথচ রোববার সকালেও খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ভালো মানের পেঁয়াজ ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছিল।
খাতুনগঞ্জের আড়তদাররা জানান, মিয়ানমার থেকে আসা পেঁয়াজ তারা এখন বিক্রি করছেন ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে। মজুদ কম থাকলেও ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের হামিদ উল্লাহ মিয়া মার্কেট সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভারতীয় পেঁয়াজ বন্ধ হওয়ায় এবং গুজবের কারণে ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত হয়ে দাম বেশি নিচ্ছে। আবার মানুষও আতঙ্কিত হয়ে বেশি পরিমাণে কিনতে চাইছে। তাতে দাম আরও বাড়ছে।”
নগরীর চেরাগী পাহাড় মোড়ে পেঁয়াজ কিনতে আসা মইনুল ইসলাম বলেন, “দোকানদাররা যে যেমন খুশি দাম নিচ্ছে। আর ক্রেতা হিসেবে সাধারণ মানুষকে ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে।”
একই কথা বললেন খাতুনগঞ্জের আড়তদার মোহাম্মদ আলী তালুকদার। তিনি বলেন, “সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে চাহিদার তুলনায় বেশি পেঁয়াজ কিনছে। সে কারণে খুচরায় গিয়ে যে যেমন পারছে তেমন দাম নিচ্ছে।”
সরবরাহ দ্রুত না বাড়লে পেঁয়াজের বাজারের অস্থিরতা সহসা কমবে না বলেই মনে করেন এই পাইকারি ব্যবসায়ী।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে চট্টগ্রাম অফিস ও দিনাজপুর প্রতিনিধি তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে]