৫২ পণ্য সরাতে মাঠে নামার আগে বিএসটিআইর প্রতিবেদন চায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ

৫২টি খাদ্যপণ্য বাজার থেকে তুলে নিতে আদালতের নির্দেশের পর খুচরা বিক্রেতারা রয়েছেন বিভ্রান্তিতে; এই নির্দেশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পাওয়া নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আছে বিএসটিআইর পরীক্ষার প্রতিবেদনের অপেক্ষায়।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2019, 03:59 PM
Updated : 13 May 2019, 07:27 PM

বাংলাদেশে পণ্যের মান নির্ধারণী সংস্থা বিএসটিআইর পরীক্ষার এক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রোববার হাই কোর্ট বাজার থেকে ১৮টি কোম্পানির ‘মানহীন’ ওই ৫২ খাদ্যপণ্য সরিয়ে নিয়ে ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়।

১০ দিনের মধ্যে এই আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে।

হাই কোর্টের আদেশের পরদিন সোমবার রাজধানীর বড় পাইকারি বাজারের একটি কারওয়ান বাজারে ওই সব পণ্য আগের মতোই বিক্রি হতে দেখা যায়। বিক্রেতারা বলেন, তারা বুঝতে পারছেন না যে কী করবেন।

কারওয়ান বাজারে প্রাণ পণ্যের অন্যতম ডিলার আব্দুল হক খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রাণের গুঁড়া হলুদ, লাচ্চা সেমাইসহ এধরনের পণ্যগুলো বাজারে খুব চলে। কিন্তু এসব পণ্যে কী ধরনের বা কোন মাত্রার সমস্যা রয়েছে, তা আমরা এখনও জানতে পারিনি। দুয়েকটি পণ্যে সমস্যা থাকলেও সব পণ্যই যে ক্ষতিকর হয়ে গেছে, এমনটা আমার মনে হচ্ছে না।

“এখন আমি কী করব, বুঝতে পারছি না। যদি সত্যিই সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে তো কোম্পানি পণ্য দেবে না আমরাও বিক্রি করব না।”

“এখন বিক্রি বন্ধ করে দিলে তো ক্রেতা হারাব। আবার যদি শুনি এই পণ্য বিক্রি করা যাবে, তখন তো ব্যবসার একটা ক্ষতি হবে। এ নিয়ে একটা ধোঁয়াশার মধ্যে আছি,” বলেন আব্দুল হক।

ওই ৫২টি কোম্পানির মধ্যে দেশের অন্যতম বৃহৎ খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী ব্র্যান্ড প্রাণের গুঁড়া হলুদ ও লাচ্ছা সেমাই রয়েছে। ড্যানিশ, ফ্রেশ ও সান এর গুঁড়া হলুদও রয়েছে এই তালিকায়। রয়েছে এসিআই ফুডের পিওর ব্র্যান্ডের গুঁড়া ধনিয়াও।

কারওয়ান বাজারে তীর ব্র্যান্ডের সরিষার তেলও দেখা যায় দোকানে দোকানে। একটি দোকানের কর্মী আনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আদালতের নির্দেশ অমান্য করে ব্যবসা করার চিন্তা তারা করছেন না। তবে দীর্ঘদিন ধরে বিক্রি হওয়া তীর ব্র্যান্ডের সরিষার তেলে কী সমস্যা, তা তারা আরও ‘ভালোভাবে’ বুঝতে চান।

সিটি গ্রুপের তীরের পাশাপাশি বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের রূপচাঁদা, শবনম ভেজিটেবল অয়েলের পুষ্টি ব্র্যান্ডগুলোও রয়েছে বিক্রি নিষিদ্ধের তালিকায়।

নিউজিল্যান্ড ডেইরির ডুডলি নুডলসও রয়েছে এই তালিকায়।

ডুডল ব্রান্ডের বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান ভিআইপি স্টোরের আলমগীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভোক্তার জন্য ক্ষতিকর পণ্য তারা বিক্রি করতে চান না। তবে তাদের দোকানে এখনও ডুডল নুডলস আছে। যখনই চূড়ান্ত নির্দেশ আসবে তারা বিক্রি বন্ধ করবেন।

আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পাওয়া জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শফিকুল ইসলাম লস্করের সঙ্গে সোমবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মাঠে নামার আগে বিএসটিআইর গবেষণা প্রতিবেদনটি পেতে চান তারা।

“ওই ৫২টি পণ্যের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগে বিএসটিআই এর ল্যাব রিপোর্টটি হাতে আসতে হবে। সেই রিপোর্ট না দেখে তো ব্যবস্থা নিতে পারছি না। কারণ পণ্যে ভেজালের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তির বিধান আইনে নির্ধারিত রয়েছে। তাই কী ধরনের ভেজাল রয়েছে, তা রিপোর্ট দেখে নিশ্চিত হতে হবে।”

নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে মাহফুজুর বলেন, “কোনো পণ্যে যদি জীবনহানির আশঙ্কা থাকে, তাহলে তার শাস্তি এক ধরনের; আবার কোনো পণ্যে যদি প্রয়োজনীয় উপাদান না দেওয়ার কারণে মান খারাপ হয়, সেটার শাস্তি অন্য ধরনের।”

তাই ঢালাওভাবে সব পণ্যের বিরুদ্ধে একই পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়ের কথা বলেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান।

তিনি বলেন, কোনো কোম্পানির কোন ব্যাচের পণ্যে ভেজাল পাওয়া গেছে তা জানতে হলেও বিএসটিআইএর রিপোর্ট হাতে পাওয়া প্রয়োজন। তাহলে সেই ব্যাচের পণ্যই অপসারণ করতে হবে।

এই প্রসঙ্গে মাহফুজুর বলেন, “পণ্য বাজারজাতকরণের দায়িত্ব যেহেতু বিএসটিআইর, তারাই এটা অপসারণের কাজ করবে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কাজ ব্যাপক।

“আমরা নিরাপদ খাদ্যের জন্য সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয়ের কাজটি করি। পাশাপাশি কোনো পণ্যে ভেজাল চিহ্নিত হলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী মামলা করার দায়িত্ব আমাদের রয়েছে।”

তবে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) উপপরিচালক রিয়াজুল হক খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পণ্যগুলো বাজার থেকে অপসারণের প্রাথমিক পদক্ষেপ নেবে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।”

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের গবেষণা প্রতিবেদন চাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “আজকের (সোমবার) মধ্যেই তাদের কাছে ল্যাবরেটরি রিপোর্ট পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আদালত ১০ দিন সময় দিয়েছে। এর মধ্যে অবশ্যই একটা কিছু হবে।”

হাই কোর্টের আদেশের পরদিন কারওয়ান বাজারে মিলছিল ৫২টি পণ্যের অনেকগুলো

তালিকার অনেক পণ্যই নেই বাজারে

গত ২ মে শিল্প মন্ত্রণালয় এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, বিএসটিআই রোজার আগে বাজার থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৫২টি নিম্নমানের খাদ্যপণ্য চিহ্নিত করেছে।

এসব প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হয়েছে এবং অচিরেই তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।

বিএসটিআই বলেছিল, গত দুই মাসে ইফতার ও সেহরির জন্য ব্যবহৃত ২৭ ধরনের খাদ্যপণ্যের ৪০৬টি নমুনা গোপন তৎপরতার মাধ্যমে বাজার থেকে সংগ্রহ করে বিএসটিআই ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। ৪০৬টি নমুনার মধ্যে ৩১৩টির ফল পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ৫২টি পণ্য নিম্নমানের।

বিএসটিআইর এই তালিকার অনেক পণ্যই বাজারে দেখা যায়নি; দোকানিদের কাছে জিজ্ঞাসা করেও এসব পণ্যের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

বিএসটিআইর দেওয়া ৫২টি পণ্যের মধ্যে রয়েছে- জিবি ব্র্যান্ডের সরিষার তেল, আরা ড্রিংকিং ওয়াটার, আলসাফি ড্রিংকিং ওয়াটার, মিজান ড্রিংকিং ওয়াটার, মর্ন ডিউ  ড্রিংকিং ওয়াটার, আরআর ডিউ ড্রিংকিং ওয়াটার, দিঘি ড্রিংকিং ওয়াটার, প্রিয়া সফট ড্রিংক পাউডার, সূর্যের মরিচের গুঁড়া, মঞ্জিলের হলুদের গুঁড়া, জেদ্দার লাচ্ছা সেমাই, অমৃতের লাচ্ছা সেমাই, কিরণের লাচ্ছা সেমাই, মদিনার আয়োডিনযুক্ত লবণ, নুরের আয়োডিনযুক্ত লবন, রূপসার দই, মক্কার চানাচুর, মেহেদীর বিস্কুট, নিশিতা ফুডসের সুজি ও গ্রিন লেনের মধু।