৫২টি মানহীন খাদ্যপণ্য বিক্রি বন্ধের নির্দেশ

বিএসটিআইর মানের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ বিভিন্ন কোম্পানির ৫২টি খাদ্যপণ্য বিক্রি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট, ব্যবস্থা নিতে বলেছে উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 May 2019, 07:14 AM
Updated : 13 May 2019, 02:10 PM

বাজারে থাকা ১৮টি কোম্পানির এসব পণ্য দ্রুত অপসারণ করে ধ্বংস এবং মানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তার উৎপাদন বন্ধ করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিএসটিআইর প্রতিবেদন শিল্প মন্ত্রণালয় প্রকাশের পর একটি রিট আবেদনে রোবববার বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ এই নির্দেশ দেয়।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে এসব নির্দেশ বাস্তবায়ন করে আগামী ১০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আদালত; এজন্য প্রয়োজনে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করতেও বলা হয়েছে।

আগামী ২৩ মে এ্ই রিট আবেদনের পরবর্তী শুনানির দিন রেখেছে আদালত।

পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে

সরিষার তেল- সিটি অয়েল মিলের তীর, গ্রিন ব্লিসিং ভেজিটেবল অয়েল কোম্পানির জিবি, বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের রূপচাঁদা, শবনম ভেজিটেবল অয়েলের পুষ্টি ব্র্যান্ডগুলো।

লবণের মধ্যে রয়েছে- এসিআই, মোল্লবো সল্ট, মধুমতি, দাদা সুপার, তিন তীর, মদিনা, স্টারশিপ, তাজ ও নূর স্পেশাল ব্র্যান্ডগুলো।

মসলার মধ্যে রয়েছে- ড্যানিশ, ফ্রেশ, বাঘাবাড়ি স্পেশাল, প্রাণ ও সান এর গুঁড়া হলুদ; এসিআই ফুডের পিওর ব্র্যান্ডের গুঁড়া ধনিয়া।

লাচ্ছা সেমাইয়ের মধ্যে রয়েছে- মিষ্টিমেলা, মধুবন, মিঠাই, ওয়েলফুড, বাঘাবাড়ি স্পেশাল, প্রাণ, জেদ্দা, কিরণ ও অমৃত ব্র্যান্ডগুলো।

নুডলসের মধ্যে রয়েছে- নিউজিল্যান্ড ডেইরির ডুডলি নুডলস। কাশেম ফুড প্রোডাক্টের ‘সান’ ব্র্যান্ডের চিপসও এই তালিকায় রয়েছে।

গত ২ মে শিল্প মন্ত্রণালয় এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, বিএসটিআই রোজার আগে বাজার থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৫২টি নিম্নমানের পণ্য চিহ্নিত করেছে।

এসব প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হয়েছে এবং অচিরেই তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।

সম্প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে পুষ্টির মেয়াদোত্তীর্ণ ভোজ্যতেল বাজারজাতের বিষয়টি ধরা পড়ে

এরপর এসব খাদ্যপণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার, জব্দ ও মান উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে গত ৮ মে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনশাস কনজ্যুমার সোসাইটি (সিসিএস)’র পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান এই রিট আবেদন করেন।

পরদিন ওই রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানিতে মানহীন খাদ্যপণ্যের তালিকা দেখে বিচারক বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, “কোনো কোম্পানিই তো বাদ নাই।”

এসব পণ্যের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা জানাতে আদালত বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের দুজন কর্মকর্তাকে তলব করে।

বিএসটিআই’র উপ-পরিচালক মো. রিয়াজুল হক ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরিচালক সহদেব চন্দ্র সাহা রোববার হাজির হওয়ার পর রুলসহ আদেশ দেয় হাই কোর্ট।         

বিএসটিআই’র ল্যাব পরীক্ষায় ধরা পরা ৫২টি নিম্নমানের খাদ্যপণ্য দেশের বাজার থেকে প্রত্যাহার বা জব্দ করতে এবং বিএসটিআই’র নির্ধারিত মান লঙ্ঘন করে নিম্নমানের ৫২টি খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, জানতে চেয়ে রুল দিয়েছে আদালত। 

খাদ্য, বাণিজ্য, শিল্প সচিব, বিএসটিআইর মহাপরিচালক (ডিজি), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

রিট আবদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোখলেছুর রহমান। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. ফরিদুল ইসলাম।

সম্প্রতি চট্টগ্রামে বনফুল ও মধুবনের মিষ্টিতে ভেজাল পেয়ে জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, নিম্নমানের ৫২টি পণ্য বাজারে থাকলে তা বাজার থেকে তুলে নিয়ে সেগুলো ডেসট্রয় (ধ্বংস) করতে। এসব কোম্পানির পণ্য বিএসটিআই’র মানোন্নয়ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।”

রিট আবেদনকারী শিহাব উদ্দিন বলেন, বিএসটিআইর মান পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ ৫২টি নিম্নমানের খাদ্যপণ্য বাজার থেকে অপসারণের পাশাপাশি এসব নিম্নমানের পণ্য উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছে, খাদ্য মানের এই পরীক্ষা শুধু রোজার মাসেই হওয়া উচিৎ না। সারা বছরই এ অভিযান থাকা উচিৎ।

খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এই দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের হলেও জনস্বার্থ বিবেচনায় বিষয়টিতে হস্তক্ষেপের কথা তুলে ধরেছে হাই কোর্ট।

পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, “যদিও এ বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের। আদালতের এগুলো দেখার বিষয় না। তারপরও জনস্বার্থ বিবেচনায় এ বিষয়গুলো আদালত এড়িয়ে যেতে পারে না।

“খাদ্য নিরাপত্তার ব্যপারে আপস করার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রত্যেকটা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত অংশগ্রহণ করা দরকার।”

সরকার প্রধানের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বিচারক বলেন, “সরকার ও সরকার প্রধানের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যে, তারা যেন খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। প্রয়োজনে খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন, যেভাবে মাদকবিরোধী অভিযানের বিষয়ে করা হয়েছে।”

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর বলেন, “আমরা আশা করি সরকার খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধের বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে।”

খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি পাইপলাইনে সাধারণ মানুষের জন্য ওয়াসার বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতেও বলেছে আদালত।