আলহাজ্ব টেক্সটাইলকে ৫৫ কোটি টাকা দিতে হচ্ছে অগ্রণী ব্যাংককে

স্থায়ী আমানত হিসেবে (এফডিআর) বিশেষ তহবিলের ৫৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলসকে পরিশোধ করতে হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংককে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Jan 2019, 04:30 PM
Updated : 17 Jan 2019, 04:30 PM

উচ্চ আদালতে এফডিআর বিরোধের এক রিট মামলার রায়ে এ নির্দেশনা এসেছে।

গত সোমবার বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি আশিস রঞ্জন দাসের হাই কোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেয়।

রায়ের ১৫ দিনের মধ্যে এ অর্থ পরিশোধ করতে অগ্রণী ব্যাংককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থ পরিশোধের পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে তা হলফনামা আকারে আদালতকে জানাতেও বলা হয়েছে।

আদালতে অগ্রণী ব্যাংকের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন এ কে এম বদরুদ্দোজা। আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলসের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম।

অগ্রণী ব্যাংকের আইনজীবী বদরুদ্দোজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অগ্রণী ব্যাংকের সুদের হার অনুযায়ী আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের পাওনা টাকা নির্ধারণ করতে কয়েক দফায় অডিট হয়। এমনকি আদালতের নির্দেশেও একবার অডিট হয়। তখন সেই অডিট রিপোর্টের বিষয়ে আপত্তিও জানানো হয়েছিল।

“কিন্তু কোর্ট একটা ভিউ দিলেন যে, অডিটর তো আইন অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ীই তারা করে থাকেন। সুতরাং সর্বশেষ অডিট রিপোর্টটি আদালত গ্রহণ করলেন এবং আমাদের ডাইরেকশন দিলেন ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে অডিটরের নির্ধারিত টাকাটা ওদের (আলহাজ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড) পেমেন্ট করে পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে একটা কমপ্লাইনস অ্যাফিডেবিট ফাইল করার জন্য।”

এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না- জানতে চাইলে এ আইনজীবী বলেন, “আমরা আপিল করতে পারি। এই জন্য যে, কথা ছিল পাওনা টাকার রেট অব ইনটারেস্ট ৫ থেকে ১৪.২৫ শতাংশ ধরা হবে। ২০১৪ সালে অডিটর পাওনা দেখিয়েছে ৩৫ কোটি টাকা। তখন আমরা ৮ কোটি ১১লাখ টাকা দিয়েছিলাম, তারা তা মানেনি।

“আবার ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর‌্যন্ত সুদের হার সাড়ে ১০ শতাংশ ধরে সর্বশেষ অডিটে আরও ২০ কোটি টাকা পাওনা দেখিয়েছে। এটাতো সরকারি ব্যাংক। সংবাদ মাধ্যমে নিউজ হওয়ার পর বিভিন্ন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বিষয়টি। ফলে বিষয়টি নিয়ে আমরা বসেছি, ব্যাংকের এমডি, চেয়ারম্যানও বসেছেন। সম্ভবত আপিলের দিকেই যাবে। আপিল বিভাগের গিয়ে বিষয়টা চূড়ান্ত হয়ে টাকাটা দেওয়া উচিৎ, যাতে আমাদের সর্বোচ্চ জাবাবদিহিতাটা নিশ্চিত হয়।”

আলহাজ টেক্সটাইলের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান পিনাকী অ্যান্ড কোম্পানির নিরীক্ষকের দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত তাদের সুদের হার অনুসারে অগ্রণী ব্যাংকের কাছে আলহাজ্ব টেক্সটাইলের পাওনা টাকার পরিমাণ হল ৫৫ কোটি ৮৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫৭৮ টাকা।

“এ নিরীক্ষকের ফি ব্যাংক ও কোম্পানি যৌথভাবে পরিশোধ করেছে। ফলে এ নিরীক্ষা প্রতিবেদন ব্যাংকের নিজস্ব প্রতিবেদন হিসেবেই আদালত গ্রহণ করে রায় দিয়েছেন।”

আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড ১৯৬১ সালে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে ‘যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরে নিবন্ধিত (রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস-আরজেএসসি) হয়। এর ছয় বছর পর ১৯৬৭ সালে এটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সরকার কোম্পানিটিকে জাতীয়করণ করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের (বিটিএমসি) অধীনে নিয়ে আসে।

কিন্তু ১৯৮২ সালে মিলটি আবার বেসরকারি খাতে দিয়ে দেওয়া হয়। এবং এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আগের মালিকদের কাছেই হস্তান্তর করে সরকার।

এসময় ২ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার ৮০৫ টাকার ঋণের দায় মালিকপক্ষ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ হিসেবে দেখানো হয় এ ঋণ হয়েছিল সরকারি সংস্থা বিটিএমসির অধীনে থাকার সময়ে।

তখন অর্থ পরিশোধের জন্য সরকার বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের (বিটিএমসি), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) ও ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় বসে।

সে আলোচনার ভিত্তিতে আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, বিটিএমসি ও ব্যাংকের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। সে চুক্তি অনুযায়ীই পরবরতীতে ঋণ পরিশোধের জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠন করা হয়।

এ তহবিলের ক্যাশ ক্রেডিট (নগদ দেনা) আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের পক্ষ থেকে এবং সুদ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পরিশোধ করার কথা ছিল।

কিন্তু ১৯৮৯-১৯৯২ সাল পর্যন্ত চার বছরে এ তহবিলে জমা পড়ে ২ কোটি ৯ লাখ টাকা। পরবর্তীতে চুক্তি অনুযায়ী বিশেষ তহবিলটিকে স্থায়ী আমানতে (এফডিআর) রূপান্তর করা হয় এবং লিয়েন মার্ক করে অগ্রণী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে রাখা হয়। ২০০৮ সালে ঋণ পরিশোধের পর অ্যাকাউন্টে ২৪ কোটি ৯৫ লাখ ৪২ হাজার ১৭৮ টাকা অবশিষ্ট থেকে যায়।

এফডিআরের অবশিষ্ট অর্থ থেকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোম্পানিকে ৫ কোটি ৭ লাখ ৬৪ হাজার ৭৯১ টাকা পরিশোধ করতে চায়। তখন আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলস এফডিআরে টাকা জমা দেওয়া বন্ধ করে দেয় এবং অগ্রণী ব্যাংকের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করে।

রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালে সুদসহ এফডিআরের অর্থ আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডকে পরিশোধের জন্য অগ্রণী ব্যাংককে নির্দেশ দিয়ে রায় দেয় আদালত।

ওই আদেশের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে আপিল করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

আপিলের রায়ে ব্যাংককে এক মাসের মধ্যে কোম্পানিকে এফডিআরের টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

কিন্তু নির্ধারিত সময়ে টাকা পরিশোধ না করায় আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলস হাই কোর্টে আদালত অবমাননার আবেদন করে রুল জারির আরজি জানায়।

আবেদনে বলা হয়, ১৯৮৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এফডিআরে অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। কিন্তু ব্যাংক মাত্র ৮ কোটি ১১ লাখ ২৫ হাজার টাকা পরিশোধ করতে চায়।

এ আবেদনের চার বছর পর গত বছর আদালতের নির্দেশে আলহাজ টেক্সটাইল ও অগ্রণী ব্যাংকের সম্মতির ভিত্তিতে পাওনা টাকার পরিমাণ নির্ধারণে পিনাকী অ্যান্ড কোম্পানিকে নিরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

সর্বশেষ এ নিরীক্ষকের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই ৫৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা অগ্রণী ব্যাংককে পরিশোধ করতে নির্দেশনা এসেছে হাই কোর্ট থেকে।