বাজেট নিয়ে ব্যবসায়ীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

প্রস্তাবিত বাজেটের বৃহৎ আকার ও উন্নয়ন পরিকল্পনাকে স্বাগত জানালেও ‘ব্যবসা স্বার্থ বিরোধী’ কিছু পদক্ষেপ থাকায় এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ব্যবসায়ী সমিতিগুলোর নেতারা।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2018, 05:18 PM
Updated : 7 June 2018, 06:38 PM

বাজেট বাস্তবায়নকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার উপস্থাপন করেছেন। নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত এই ব্যয় বিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ২৫ এবং মূল বাজেটের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি।

সন্ধ্যায় বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা একটা বড় বাজেট হলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়, জিডিপির আকার ও ক্রমবর্ধমান জিডিপি গ্রোথের বিবেচনায় খুব বেশি বড় বাজেট বলে মনে করি না। এখন চ্যালেঞ্জ হলো এর বাস্তবায়ন।

“অবকাঠামো উন্নয়নে যথেষ্ট বরাদ্দ রাখা হয়েছে। উন্নয়নগুলো যাতে যথা সময়ে শেষ হয়, অর্থাৎ এই বছরে যেসব কাজ শেষ করার পরিকল্পনা আছে তা যেন যথা সময়ে শেষ হয়। এদিকে তত্ত্বাবধায়ন বাড়াতে হবে।”

বাজেটের আগে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে এফবিসিসিআই যেসব প্রস্তাব দিয়েছিল তার অনেক কিছু বাস্তবায়ন হয়নি বলে জানান তিনি।

শফিউল বলেন, “আমাদের কিছু ছোট ছোট দাবি ছিল যার অনেকগুলোই বাস্তবায়ন হয়নি। করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সেটা করা হয়নি। এক্সপোর্ট সেক্টরে আরও বেশি সুবিধা দেওয়ার দরকার ছিল। গতবার যে এক শতাংশ ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছিল সেটা পরে এসআরও’র মাধ্যমে কমিয়ে দশমিক ৭০ শতাংশ করা হয়িছিল। আমরা চেয়েছিলাম সেটা আরও সুবিধাজনক পর্যায়ে আসুক, কিন্তু হয়নি।”

এফবিসিসিআইয়ের দাবিগুলো রপ্তানি বাড়ানো ও রপ্তানিমুখী শিল্পকে শক্তিশালী করার জন্যই দেওয়া হয়েছিল দাবি করে তিনি বলেন, “এক্সপোর্টটা মাত্র ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছরে এক্সপোর্ট ৪ দশমিক ২০ শতাংশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এবার এটাকে আরও সুযোগ দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু করপোরেট ট্যাক্সসহ আরও কিছু ট্যাক্সের কারণে সেটা হয়নি।”

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর এর ১২০ ধারা বাতিলে তাদের জোর দাবি থাকলেও বাজেটে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি বলে জানান শফিউল ইসলাম।

তিনি বলেন, “আমরা বলেছিলাম, ইনকাম ট্যাক্সের ১২০ ধারা একটি কালো আইন। এটা একটা কর্তৃপক্ষকে কর্তৃত্ববাদী করে দেয়। কারণ ওরাই এসেসমেন্ট করবে, ট্রাইব্যুনাল করবে, ওরাই আবার রিট করবে, তারাই সব সিদ্ধান্ত নেবে, এটা তো ঠিক না। এতে হয়রানি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটাকে তুলে দেওয়া দরকার। কিন্তু সেটা করা হয়নি।”

পোশাকখাতে করপোরেট ট্যাক্স বৃদ্ধি এই খাতের প্রবৃদ্ধিতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “পোশাক খাতের ঘুরে দাঁড়ানোটাকে উৎসাহিত করা উচিত। এই খাত ঘুরে দাঁড়ালে পরোক্ষ ট্যাক্স বেশি আদায় হবে। আর এই খাতের করপোরেট ট্যাক্স ১২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে মূলধন গঠন বাধাগ্রস্ত হবে। আমার মনে হয়, এটা আগের মতো ১০ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে রাখাই যুক্তিযুক্ত হবে।”

বাজেটে ব্যবসায়ীদের জন্য ইতিবাচক কী আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অনেকগুলো ইতিবাচক খবরের মধ্যে একটি হচ্ছে- কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে ১ শতাংশ, ৫ শতাংশ, ২৫ শতাংশ এ রকম একটা স্ল্যাব দিয়েছিলাম। উনারা আমাদের এই প্রস্তাবটা রেখেছেন, এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।”

পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “বাজেটে কিছু কিছু বিষয় ব্যবসায়ীদের জন্য আমরা বলেছিলাম। সেই বিষয়গুলোর প্রতিফলন হয়নি। আমরা মনে করি, সামনে যে আলোচনার সুযোগ আছে, সেখানে যদি আলোচনার মাধ্যমে এগুলোর সমাধান করা হয় তাহলে এই বাজেট ব্যবসাবান্ধব এবং কর্মসংস্থানবান্ধব হবে।”

বাজেটে পোশাকখাতে করপোরেট ট্যাক্স বৃদ্ধি নতুন বিনিয়োগ ও রপ্তানিখাত সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মন্তব্য করেন এই রপ্তানিকারক।

“অর্থমন্ত্রী পোশাকখাতের অগ্রগতির প্রশংসা করেছেন। অনেক আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আমরা মনে করেছিলাম, হয়ত আমাদের করপারেট ট্যাক্সটা আরও কমিয়ে দেবে। সেখানে দেখা গেল উল্টো করপোরেট ট্যাক্স ১২ এবং ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এটা কোনোভাবেই আমাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির এই বড়খাতকে উৎসাহ যোগাবে না, নতুন বিনিয়োগ উৎসাহ যোগাবে না।”

এবার বাজেটে প্রথমবারের মতো অনলাইন কেনাকাটায় ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার এই পদক্ষেপকে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য ‘একটা আত্মঘাতী’ সিদ্ধান্ত বলছেন এই খাতের অন্যতম উদ্যোক্তা একেএম ফাহিম মাসরুর।

তিনি একই সঙ্গে দেশে চাকরির সবচেয়ে বড় অনলাইন বাজার বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং বাংলা সোশ্যাল মিডিয়া বেশতো ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী।

পাশাপাশি দেশের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) নির্বাহী কমিটির পরিচালক ফাহিম মাসরুর।

বাজেট প্রতিক্রিয়ায় তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাজেটে নতুন কিছু নেই। একটা খারাপ ব্যাপার ঘটেছে অনলাইন ব্যবসার ক্ষেত্রে। এখানে ৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হবে।

“যেখানে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা হচ্ছে সেখানে এমন একটি সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হবে। মানুষজনকে ডিজিটাল ট্রেন্ডস থেকে নিরুৎসাহিত করবে। হঠাৎ করে কেন এটা করা হলো সেটা বোঝা খুব মুশকিল। এই সেক্টরটা একবারেই ইমার্জিং সেক্টর। প্রতিটি লোকাল কোম্পানি প্রচুর লোকসান দিয়ে এখানে বাজার সৃষ্টি করছে।”

তার মতে, বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য এই ৫ শতাংশ ভ্যাট ‘কোনো ব্যাপার না হলেও’ লোকাল কোম্পানিগুলোর জন্য বড় আঘাত হবে।

“অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। এই টাকাটা কাস্টমারকে নয়, এটা ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের পরিশোধ করতে হবে।”

ই-কমার্স খাত থেকে ৫ শতাংশ ভ্যাট আদায়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে বলেও মনে করেন ফাহিম মাশরুর।

তিনি বলেন, “অনেকে ফেইসবুকের মাধ্যমে ব্যবসা করে। তাদের চিহ্নিত করা কঠিন হবে। অন্যদিকে আমরা যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অফিস নিয়ে আছি আমাদের ভ্যাট দিয়ে যেতে হবে। তাহলে সবার কাছ থেকে এটা আদায় করাও যাবে না।”

ফেইসবুক ও ইউটিউবে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে ভ্যাট আরোপকে সমর্থন করেন তথ্য-প্রযুক্তি খাতের এই উদ্যোক্তা।

“যদিও এতে অনেক ডিফিকাল্টিজ আছে, তবুও এটাকে আমরা সমর্থন করি। কারণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে বিজ্ঞাপন দিলে যেখানে ভ্যাট দিতে হয়, সেখানে তাদেরও ভ্যাট দেওয়া উচিত। এখন কীভাবে সেটা আদায় হবে সেটা সরকার দেখেবে,” বলেন তিনি।