পেঁয়াজে অসহনীয় ঝাঁজ

টানা কয়েক মাস ধরে পেঁয়াজের দাম বাড়ার পর গত সপ্তাহে কিছুটা কমলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির প্রধান আমদানি উৎস ভারত রপ্তানিমূল্য বাড়িয়ে দ্বিগুণ করার পর আরও একধাপ বেড়ে কেজিতে শতকের ঘর ছুঁয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকফয়সল আতিক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Nov 2017, 02:28 PM
Updated : 25 Nov 2017, 03:25 AM

শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ একাধিক বড় বাজারে প্রতি কেজি ৯৫ টাকা দরে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করছিলেন খুচরা বিক্রেতারা; আর পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছিল ১০০ টাকায়।

গত সপ্তাহেও এই পণ্যটি ঢাকায় খুচরা পর্যায়ে ৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়।

ক্রেতা-বিক্রেতারা বলছেন, খুব সম্প্রতি পেঁয়াজের দাম এতো অসহনীয় পর্যায়ে আর পৌঁছেনি; স্মরণকালে কেজিপ্রতি পণ্যটির দর ১০০ টাকায় উঠেনি।

ঢাকার রায়ের বাজারের মহল্লার দোকানে পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে দাম শুনে হতভম্ব হয়ে যান রাগিব হাসান।

বিডিনিউজ  টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পাঁচদিন আগে যেই পেঁয়াজ ৬৫ টাকায় কিনলাম। .. (আজ) দেশি পেঁয়াজ কেজি একশ, ভারতীয়টা ৭৫ টাকা। এতো অল্প সময়ে একটি পণ্যের দাম এভাবে বাড়ে কীভাবে?”

রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, শুক্রবার আমদানি করা পেঁয়াজের দাম গত সপ্তাহের চেয়ে কেজিতে ১৫ টাকা বেড়ে মানভেদে ৬৫ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি পেঁয়াজও কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

পেঁয়াজের দাম বাড়ার বিষয়ে আমদানিকারক পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের আব্দুল মাজেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভারত রপ্তানি পেঁয়াজের দাম প্রতিটন ৮৫০ ডলার করে ফেলেছে। আমদানি পেঁয়াজ পাইকারিতেই এখন প্রতিকেজি ৭২ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।

“বাজারের এই অস্থির অবস্থার মধ্যে আপাতত পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রেখেছি। বাজারে নতুন পেঁয়াজ উঠার আগে দাম স্থিতিশীল হবে বলে মনে হচ্ছে না,” বলেন মাজেদ।

ভারতে পেঁয়াজের দরের ব্যাপক ঊর্ধ্বগতির মধ্যে বৃহস্পতিবার স্থানীয় বাজারে সরবরাহ বাড়াতে ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য (এমইপি) আগের বারের চেয়ে দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৮৫০ ডলার নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।  

এর আগে ২০১৫ সালের জুনে ভারত সব ধরনের পেঁয়াজের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য ২৫৫ ডলার থেকে বাড়িয়ে টনপ্রতি ৪৩০ ডলার নির্ধারণ করে দিলেও ডিসেম্বর নূন্যতম রপ্তানিমূল্য প্রত্যাহার করে নেয়।

ভারতীয় গণমাধ্যম ইকনোমিক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির কয়েকটি রাজ্যে পেঁয়াজের দাম বেড়ে প্রতি কেজি ৭০ রুপিতে পৌঁছেছে। মওসুমের শেষ পর্যায়ে এসে মিশর ও চীন থেকে  পেঁয়াজ আমদানিও শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা।

চলতি বছরের এপ্রিল-জুলাই সময়ে ভারত থেকে মোট ১২ লাখ টন পেঁয়াজ রপ্তানি করা হয়, যা আগের বছরের ৫৬ শতাংশ বেশি। এর পর অগাস্টে ভোক্তা বিষয়ক মন্ত্রী রাম বিলাস পাসওয়ান ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য বসাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশও করেন।

তবে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই বাজারে খরিফ (শুষ্ক) মওসুমের নতুন পেঁয়াজ আসা শুরু করলে দাম কিছুটা কমবে। কিন্তু এই সময়ের পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায় না বলে ওই সময় ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য আরোপিত থাকলে ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন ভারতের চাষীরা। কারণ তখন বাংলাদেশেও নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসলে তারা বিক্রেতা সংকটে পড়বেন।

শুক্রবার ঢাকার কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজের পাইকারি বিক্রেতা মোসলেম মিয়া বলেন, “বৃহস্পতিবারও পাইকারি পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৮৫ থেকে ৯০ টাকা ছিল। এখন ৯৫ টাকার নিজে কোনো পেঁয়াজ নেই। সহসা দাম কমবে বলে মনে হচ্ছে না।”

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোরবানির ঈদের সময় বাড়তি প্রায় ২ লাখ টন সহ দেশে বছরে ২৪ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা আছে। এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ টন দেশেই উৎপাদিত হয়, বাকিটা মূলত ভারত থেকে আমদানি হয়।

কিন্তু ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সম্প্রতি অতিবৃষ্টি থেকে সৃষ্ট বন্যার কারণে পেঁয়াজের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। খরিফ মওসুমেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ফলন হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

চলতি বছর জুলাইয়ের শেষভাগে হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম কেজি প্রতি ২০-২৫ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকার উপরে ওঠে। এর মধ্যে পরিস্থিতি সামলাতে ভারতের বিকল্প হিসাবে মিশর থেকে পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। কিন্তু আগের দামে আর ফেরেনি পেঁয়াজ। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, পেঁয়াজ আমদানির জন্য চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ৬ কোটি ৩৯ লাখ ৩০ হাজার ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছিল। এর মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বরে খোলা হয়েছে ৩ কোটি ৪১ লাখ ডলারের এলসি। শুধু অক্টোবরে মোট ২ কোটি ৪৩ লাখ ৪০ হাজার ডলারের ঋণপত্র নিষ্পত্তির বিপরীতে ৮০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে।

এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ১০ লাখ ৪১ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৪৭ শতাংশ বেশি। এর পর জুলাই মাসে আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার টন পেঁয়াজ, যা আগের মাসের তুলনায় ৫৫ শতাংশ বেশি।

এদিকে শুক্রবার ঢাকার বাজারে পেঁয়াজের সঙ্গে রসুন ছাড়া অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দরে তেমন একটা উঠানামা হয়নি; এর মধ্যে মওসুমের কারণে শীতকালীন শাক-সবজির দাম কিছুটা কমেছে।

টিসিবির হিসাবে, রসুনের দাম প্রতি কেজি ১০ টাকা বেড়ে দেশিটা সর্বোচ্চ ৮০ টাকা ও আমদানি করাটা ১০০টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এছাড়া প্রতিকেজি বেগুন, শালগম ও করলা ৩৫ টাকা, মুলা, পটল ও চিচিঙ্গা ৩০ টাকায়, বরবটি ৪০ টাকা, শিম ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাজারে ৫০ কেজির বস্তা মোটা চাল দুই হাজার টাকা, মিনিকেট দুই হাজার ৮৫০ থেকে দুই হাজার ৯০০ টাকার এবং নাজিরশাইল দুই হাজার ৬০০ থেকে তিন হাজার ২০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহের দরের সঙ্গে খুব একটা হেরফের হয়নি।

কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা পলাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শীতের সবজির দাম কমলেও আরেক ধাপ বেড়ে গেছে পেঁয়াজের দাম। তাই ক্রেতাদের খরচ আর কমছে না। সবজি থেকে যেই টাকা বাঁচবে তা চলে যাবে পেঁয়াজে।”