বিদ্যুতের দাম কমানো সম্ভব, মানছে পিডিবিও

অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ছেটে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার ১ দশমিক ৫৬ টাকা কমানোর কর্মকৌশল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছে উপস্থাপন করেছে ভোক্তাদের সংগঠন ক্যাব।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Oct 2017, 03:20 PM
Updated : 5 Oct 2017, 03:20 PM

বিদ্যুতের একক ক্রেতা ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড, পিডিবি তাদের প্রস্তাবের সঙ্গে পুরোপুরি একমত না হলেও কয়েকটি ধাপে ব্যয় সাশ্রয় করে ইউনিট প্রতি ৫৫ পয়সা দাম কমানোর সম্ভব বলে মনে করছে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর টিসিবি অডিটোরিয়ামে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার কমাতে বিশেষ গণশুনানির আয়োজন করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, বিইআরসি। সেখানে দাম কমানোর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম।

পিডিবি গত ২৫ সেপ্টেম্বর পাইকারি বিদ্যুতের দাম ইউনিট প্রতি ৭২ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করে। এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে বিদ্যুতের দাম কমানোর পক্ষের নজিরবিহীন এই শুনানিতে ক্যাব প্রতিনিধি ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা শুনানিতে অংশ নেন।

শুনানির শুরুতে ক্যাব অভিযোগ করে, ভোক্তা পর্যায়ে তরল জ্বালানির মূল্যহার নির্ধারণের একক ক্ষমতা বিইআরসির হলেও জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে সেই কাজটি করে। জ্বালানির বর্তমান মূল্যহার যৌক্তিক, সমতাভিত্তিক হয়নি। এই মূল্যহারের ভিত্তিতে বিদ্যুতের মূল্যহার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন ও কর্তৃত্ব বহির্ভূত।

ক্যাবের যুক্তি, পিডিবির ব্যয়হারে প্রতি ইউনিটে বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল বাবদ ২৬ পয়সা, ভর্তুকির সুদ বাবদ ২১ পয়সা, পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহার ঘাটতি বাবদ ৫ পয়সা এবং মেঘনাঘাট আইপিপিতে ফার্নেসওয়েলের পরিবর্তে ডিজেল ব্যবহারে ঘাটতি বাবদ ১৪ পয়সা অর্থাৎ মোট ৬৬ পয়সা যুক্ত আছে। এগুলো অযৌক্তিক ও বিতর্কিত। অন্যদিকে আয়হারে ভোক্তাপর্যায়ে ১৩২ কেভি লেভেলে বিদ্যুৎ বিক্রিতে উদ্বৃত্ত আয় ইউনিট প্রতি ৮ পয়সা এবং পাওয়ার ফ্যাক্টর কারেকশন চার্জ বাবদ ৪ পয়সা অর্থাৎ মোট ১২ পয়সা যুক্ত করা হয়নি।

“শুধু পিডিবির হিসাবপত্র থেকে বিবেচনা করে এই দুই খাত মিলিয়ে দেখলে মূল্য সমন্বয়ে ৭২ পয়সা বাড়ানোর পরিবর্তে ইউনিট প্রতি ৬ পয়সা উদ্বৃত্ত থাকে। মেঘনাঘাটে ১৪ পয়সার স্থলে ৯ পয়সা ধরলেও এক পয়সা উদ্বৃত্ত থাকে,” বলেন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম।

দাম কমাতে যা করতে হত

কীভাবে বিদ্যুতের দাম কমানো যেত, তার পক্ষে কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরেছে ক্যাব-

>>অধিক ব্যয়বহুল গ্যাসভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আসা বিদ্যুতের মূল্যহার ইউনিট প্রতি ৩.৩৭ টাকা। অথচ একই জ্বালানি (গ্যাস) সরকারি উৎপাদন কেন্দ্রে পোড়ালে প্রতি ইউনিট ৮৬ পয়সায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত। ফলে সাশ্রয় হত এক হাজার ৩০১ কোটি ৪১ লাখ টাকা।

>>মেঘনাঘাট আইপিপিতে গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন হলে ব্যয় সাশ্রয় হত এক হাজার ৩৩২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।

>> বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির দাম দরপতন সমতাভিত্তিক সমন্বয় করা হলে ফার্নেস ওয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুই হাজার ১১০ কোটি ৫১ লাখ টাকা এবং ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫৬০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা সাশ্রয় হত।

>>ডিজেলভিত্তিক ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রেখে কম খরচের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখলে সরকারি ও রেন্টাল-কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় সাশ্রয় হত ৭৫২ কোটি টাকা।

এই বিষয়গুলো মেনে চললে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কমপক্ষে সাত হাজার ৮৪৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা সাশ্রয় হত। ফলে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পেত ইউনিট প্রতি এক টাকা ৫৭ পয়সা। তখন পাইকারি বিদ্যুৎ ৪.৯০ টাকার পরিবর্তে ৩.৩৪ টাকায় দেওয়া যেতে বলে দাবি করেন ক্যাব উপদেষ্টা।

এই দাবির পক্ষে শুনানিতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন শামসুল আলম।

পিডিবির মহা-ব্যবস্থাপক (কমার্শিয়াল) কাউসার আমির আলি শুনানিতে তার বক্তব্যে বলেন, এসব বক্তব্যের কিছু যথার্থতা থাকলেও বাস্তবায়নের সব ক্ষমতা পিডিবির হাতে নেই। অনেক দাবি বাস্তবিক বা যথাযথও নয়। 

“ক্যাবের দাবি অনুযায়ী উৎপাদন ব্যয়ে ইউনিট প্রতি ১.৩২ টাকা হারে উদ্বৃত্ত করা বাস্তবসম্মত নয়। তবে ব্যয়ে অন্তর্ভূক্ত বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল বাবদ ২৬ পয়সা, ভর্তুকির সুদ বাবদ ২১ পয়সা, ১৩২ কেভি লেভেল সিঙ্গেল বায়ারের অধীনে অন্তর্ভুক্ত করলে ৮ পয়সা অর্থাৎ মোট ৫৫ পয়সা হ্রাস করা যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে বিইআরসি কর্তৃক সমন্বয়ের ব্যবস্থা করতে হবে এবং ভর্তুকির ৪৩০০ কোটি টাকা পিডিবির হাতে আসতে হবে।”

শুনানিতে সিপিবি নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি আবুল মকসুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমএম আকাশ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, এফবিসিসিআই পরিচালক আমজাদ হোসেন, সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনসহ বেশ কয়েকজন ভোক্তা বিদ্যুতের দাম কমানোর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন।