চাল মজুদ: কালো তালিকাভুক্ত ১৬ হাজার মিলার

অবৈধভাবে চাল মজুদ করায় ১৬ হাজার মিল মালিককে তিন বছরের জন্য ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করার কথা জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 July 2017, 09:38 AM
Updated : 13 July 2017, 09:45 AM

সচিবালয়ে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি জানান, কালো তালিকাভুক্ত এসব মিলারদের কাছ থেকে আগামী তিন বছর সরকার চাল কিনবে না।

কামরুল বলেন, “বাজারে চালের দাম বাড়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা হাওর অঞ্চলে অকাল বন্যার পর থেকেই চাল মজুদ করেছিল। আমরা যে ক্রয়মূল্য (৩৪ টাকা) দিয়েছিলাম, বাজারের মূল্যের সঙ্গে বিরাট ফারাক ছিল। ফলে আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি।”

অসাধু চাল ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমন প্রশ্নে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, “যেসব মিল মালিকরা অসাধুভাবে চাল মজুদ করেছে তাদের আমরা তিন বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করেছি। তাদের কাছ থেকে আমরা আর চাল কিনব না। সংখ্যা লক্ষাধিক।”

সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রীর ডান পাশে বসে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. বদরুল হাসান এ সময় নিচুস্বরে মন্ত্রীকে বলেন, “না হাজার।”

মন্ত্রী বলেন, “কয় হাজার?”

ডিজি বলেন, “মোট তো ১৮ হাজার এর মধ্যে ১৬ হাজারের মত হবে।”

এরপর কামরুল বলেন, “আমি স্যরি। ১৬ হাজারের মত সেই সংখ্যা, সেই সংখ্যা হচ্ছে ১৬ হাজার, যাদেরকে আমরা কালো তালিকাভুক্ত করেছি।”

টানা কয়েক বছর বাম্পার ফলনের কারণে টানা কয়েক বছর চালের বাজার স্থিতিশীল থাকলেও এবার বোরো মৌসুমে আগাম বন্যায় সরকারি হিসাবে ছয় লাখ টনের মতো ধান নষ্ট হয় হাওরে। পাশাপাশি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে (১০ টাকা কেজি দরের চাল) সাড়ে সাত লাখ টন চাল বিতরণ করায় সরকারি মজুদ অনেক কমে আসে।

এই পরিস্থিতিতে বাজারে চালের দাম বাড়তে শুরু করলে সরকার উগ্যোগী হয়। সরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির জন্য দরপত্র দেওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।

ফাইল ছবি

রোজার মধ্যে চালের দাম যখন ৬০ টাকা কেজিতে পৌঁছে গেল, তখন পাইকার ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ছিল, স্থানীয় পর্যায়ের শিল্প গ্রুপগুলো অটোমিল করে সারা দেশের চালের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে সরকার চেষ্টা করেও তখন চালের মূল্য স্বাভাবিক অবস্থায় নামিয়ে আনতে পারেনি।

সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাও জুনের শেষে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য ‘অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিকে’ দায়ী করেন।

দেশে এক সময় সনাতন পদ্ধতির চাতাল থেকে চাল উৎপাদন হলেও এখন চালের বড় অংশের সরবরাহ আসে অটো রাইস মিল থেকে। বাংলাদেশ অটো মেজর হাস্কিং রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, এই সংখ্যা ১৬ হাজারের মত।

বাংলাদেশে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত চালকলের সংখ্যা জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বদরুল হাসান পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশে প্রায় ২০ হাজার মিল আছে, যাদের মধ্যে ১৬ হাজার মিলকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।”
 
সেক্ষেত্রে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত চার হাজার মিল থেকে চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা সম্ভব কি না- এ প্রশ্নে বদরুল বলেন, “সরকার অভ্যন্তরীণভাবে ১০ থেকে ১২ লাখ টন চাল সংগ্রহ করে। এই পরিমাণ চাল দুই থেকে আড়াই হাজার মিল থেকেই সংগ্রহ করা যাবে।”

অগাস্টের মধ্যে আসবে আড়াই লাখ টন চাল

খাদ্যমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, বেসরকারিভাবে ভারত থেকে চাল আসার পর মজুদকরীরা এখন ধরে রাখা চাল বাজারে ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

সরকারিভাবে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা চালের প্রথম চালানে ২০ হাজার মেট্রিক টন চাল নিয়ে একটি জাহাজ বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে এসেছে জানিয়ে কামরুল বলেন, “কিছু কাস্টমস ফরমালিটিজ আছে, সেগুলো যদি আজকে শেষ হয় তাহলে কালকে সকাল থেকে খালাস করতে পারব। আর ফরমালিটিজগুলো যদি আজকে শেষে হতে বিলম্ব হয় তাহলে রোববার খালাস হয়ে যাবে।”

ভিয়েতনাম থেকে সরকারিভাবে মোট আড়াই লাখ টন চাল আমদানি করা হচ্ছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় চালানে ১৮ জুলাই ২২ হাজার টন এবং ৩০ জুলাই ২১ হাজার টন ও ৩০ হাজার টনের চালান দেশে আসবে বলে জানান কামরুল।

ভিয়েতনামে বাকি চাল জাহাজে তোলা শুরু হয়ে গেছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “আগামী ১৫ থেকে ২০ জুলাইয়ের মধ্যে সব চাল লোডিং শেষ হবে, এরপর আসতে যতটুকু সময় লাগে।”

সরকারিভাবে চাল আনতে চারটি টেন্ডার হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবারও আরেকটি টেন্ডার হচ্ছে। টেন্ডারে ৪০ দিনের মধ্যে চাল সরবারহ করতে বলা হচ্ছে। ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকেও সরকারিভাবে চাল আসছে।

ফাইল ছবি

“সাড়ে চার লাখ মেট্রিক টন চাল পাইপ লাইনে আছে। যে চালগুলোর বেশিরভাগ এই মাসের মধ্যে পেয়ে যাচ্ছি। ইনশাল্লাহ অগাস্টের মধ্যে সাড়ে চার লাখ টন চাল আমাদের ঘরে চলে আসবে। আমরা আশা করছি এর কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। টেন্ডার হতেই থাকবে, টেন্ডার বন্ধ থাকবে না, টেন্ডার চলতেই থাকবে।”

তিনি জানান, আগামী ১৬ জুলাই ভারতের একটি প্রতিনিধি দল এবং ২৮ জুলাই থাইল্যান্ডের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা আসবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, তাদের সঙ্গে বসে দরদাম ঠিক কের জিটুজি ভিত্তিতে চাল আনা হবে।

এছাড়া কম্বোডিয়া সমঝোতা চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, “অগাস্টে কম্বোডিয়া যাব। সেখান থেকেও জিটুজি ভিত্তিতে চাল আনতে পারব। মিয়ানমারও আমাদের চাল দিতে আগ্রহী।”

মজুদ কত- বললেন না মন্ত্রী

বর্তমানে দেশে কি পরিমাণ চাল মজুদ আছে তা জানতে সাংবাদিকরা দফায় দফায় প্রশ্ন করলেও উত্তর দেননি খাদ্যমন্ত্রী। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তরাও চালের প্রকৃত মজুদ নিয়ে কোনো কথা বলছেন না।

মজুদ কম থাকায় চালের দাম বেড়েছে- এমন প্রশ্নে কামরুল বলেন, “এটা যারা বলেছে তারা ভুল ব্যাখ্যা করছে। আমরা শুধু সরকারি বিতরণ ব্যবস্থায় চাল সরবারহ করি।”

বর্তমানে চালের মজুদ কত - এই প্রশ্নে কামরুল বলেন, “পর্যাপ্ত মজুদ আছে।”

চালের মজুদ নিয়ে নানা ধরনের তথ্য পাওয়ার কথা একজন সাংবাদিক জানালে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি আপনাদের যে ব্রিফ করলাম আমাদের পর্যাপ্ত মুজদ আছে, এখন এই মুর্হূর্তে ত্রাণ তৎপরতা ছাড়া খরচ করার অন্য কোনো খাত নাই। সেপ্টেম্বরে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি আসবে। যে কোনো ব্যাপারে সহায়তা দেওয়ার মত যথেষ্ট পরিমাণ চাল মজুদ আছে, মজুদ কেবল বাড়ছেই।”

মজুদ কতটুকু- আবারও এমন প্রশ্নে কামরুল বলেন, “আমি আর কিছুই বলতে চাই না।

“আমি বলতে চাই, ট্যারিফ উঠিয়ে দেওয়ার পর ঈদের পর থেকে ভারত থেকে বেসরকারিভাবে ৮৪ হাজার টন চাল দেশে এসেছে। এখন আমাদের কোনো রকম সমস্যা নাই, অভ্যন্তরণীভাবেও চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে।”

কামরুল বলেন, “আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আমাদের মজুদ অগাস্টের মধ্যে হ্যান্ডসাম করতে পারব এবং আগামী মাসের মধ্যে ৮ থেকে ১০ লাখ টন মজুদ আমাদের হবে। অগাস্ট-সেপ্টেম্বরের মধ্যে মজুদ কমপক্ষে ১২ লাখ টন করতে চাচ্ছি “

সাংবাদকিদের এ নিয়ে আর ‘নেগেটিভ নিউজ’ পরিবেশনের সুযোগ থাকবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখন থেকে মজুদ সংক্রান্ত বিষয়ে আপনাদের পজিটিভ নিউজই আশা করছি এবং পজিটিভ হবে বলে আশা করছি। নেতিবাচক নিউজ করারই সুযোগ পাবেন না।”

সরকার দেরিতে চাল আমদানি প্রক্রিয়া কেন শুরু করল- এমন জিজ্ঞাসায় মন্ত্রী বলেন, “আমরা যথাসময়ে চাল আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করেছি। আমরা ট্যারিফ উঠিয়ে দেওয়ার জন্য আগেই চিঠি লিখেছিলাম, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কৃষকদের স্বার্থের কথা চিন্তা করেছেন।

“কৃষকরা যেন তাদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পান, সে জন্য প্রধানমন্ত্রী ট্যারিফটা দেরিতে উঠিয়েছেন এবং ট্যারিফটা যথাসময়ে উঠিয়েছেন। যথাসময়ে ট্যারিফ উঠানোর যে প্রতিক্রিয়া, সে প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ্য করছি বাজার ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী হচ্ছে।”