ই-বর্জ্য বিধিমালা: বাতিল টিভি, ফ্রিজ কম্পিউটার ‘ফেরত নেবে’ বিক্রেতাই

বছর বছর বাড়তে থাকা ইলেকট্রনিক বর্জ্যের দূষণ থেকে পরিবেশকে বাঁচাতে একটি বিধিমালা করছে সরকার, যেখানে প্রাত্যহিক ব্যবহারের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রী বাতিল বা মেয়াদোত্তীর্ণ হলে তা বিক্রেতা বা উৎপাদনকারীর মাধ্যমেই ফেরত নেওয়ার সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলাম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2017, 05:26 PM
Updated : 19 May 2017, 05:28 PM

এর ফলে টিভি, ফ্রিজ, ওভেন, ইস্ত্রি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, মোবাইল, ফোন, ফ্যাক্স, ক্যামেরা, ডিভিডি প্লেয়ার, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, নোটবুক ও ইলেকট্রনিক বাদ্যযন্ত্রের মত সামগ্রী বাতিল হয়ে গেলে সেগুলো ফেলে না দিয়ে ফেরত দেওয়া যাবে।

এক্ষেত্রে এসব ঘরোয়া যন্ত্রপাতি, তথ্য প্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতি, মেডিকেল যন্ত্রসহ পাঁচ ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্র বিক্রির সময় ক্রেতার কাছ থেকে পণ্যের দামের সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ অর্থ জামানত হিসেবে রাখবে পণ্য প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারী কোম্পানি।

সেই পণ্যের মেয়াদ পূর্ণ হলে বা বাতিল হয়ে গেলে ভোক্তারা তা ফেরত দিলেই জামানত হিসেবে রাখা অর্থ প্রচলিত হারে সুদসহ ফেরত পাবেন।

এসব নিয়ম রেখেই ‘ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক পণ্য হইতে সৃষ্ট বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালার’ একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে বলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ) মো. নুরুল করিম জানান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, বিধিমালার খসড়া করার সময় বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছেন তারা। এখন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে বিধিমালাটি চূড়ান্ত করা হবে।

বিধিমালা চূড়ান্ত হওয়ার পর ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগে পাঠানো হবে। সেখান থেকে ছাড়পত্র পেলেই গেজেট আকারে জারি করা হবে।

দেশে প্রতি বছর কী পরিমাণ বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম আবর্জনার ভাগাড়ে যাচ্ছে, তার কোনো সরকারি হিসাব নেই। তবে বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশের বড় শহরগুলোতেই ই-বর্জ্যের পরিমাণ ছিল এক কোটি ১০ লাখ টন।

প্রতি বছর এই বর্জ্য বাড়লেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কাঠামো গড়ে না ওঠায় এসব পণ্য থেকে পরিবেশে ছড়াচ্ছে মার্কারি, লেড, জিংক, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, নাইট্রাস অক্সাইডের মত ৩৬ ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান। এর প্রভাবে ক্যান্সার, কিডনি জটিলতা, উচ্চ রক্তচাপ, হরমোন জটিলতা, বিকলাঙ্গ অবস্থায় শিশুর জন্মসহ নানা ধরনের ক্ষতির বিষয়ে হুঁশিয়ার করে আসছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

ফেরত দেওয়া যাবে যেসব সামগ্রী

ঘরোয়া যন্ত্রপাতি: কম্প্যাক্ট ফ্লুরোসেন্ট ল্যাম্প বা মারকারিযুক্ত বাতি, লেডযুক্ত ক্যাপাসিটর, ক্যাডমিয়াম এবং এর যৌগধারী থারমাল কাট-অফ, রেফ্রিজারেটর, কাপড় ধোয়ার যন্ত্র, থালা-বাসন ধোয়ার যন্ত্র, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, রান্না বা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত অন্যান্য ইলেকট্রিক বা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক হিটার, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ইস্ত্রি এবং অনুরূপ অন্যান্য যন্ত্রপাতি, টোস্টার, ব্লেন্ডিং মেশিন, কফি মেকার, ফ্রাই পান, টেলিভিশন, ডিভিডি প্লেয়ার, ভিডিও ক্যামেরা, ভিডিও ধারণ যন্ত্র, ডিজিটাল ক্যামেরা, রেডিও, অডিও অ্যামপিফ্লায়ার, ইলেকট্রিক বা ইলেকট্রনিক বাদ্যযন্ত্র এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র।

মনিটরিং ও কন্ট্রোল ইনস্ট্রুমেন্ট: ধোঁয়া নির্ণয়কারী যন্ত্র, শিল্প-কারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কন্ট্রোল প্যানেল, তাপ নিয়ন্ত্রক থার্মোস্ট্যাট, বাড়ি বা গবেষণাগারে ব্যবহৃত ওজন নির্ণায়ক যন্ত্র, ধোঁয়া নির্বাপক, তেজস্ক্রিয় পদার্থ নেই এমন পরীক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা শিল্প-বিদ্যুৎকেন্দ্রে স্থাপিত যন্ত্র, কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র, ঘরোয়া কাজে ও পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের পরিমাপক এবং বিভিন্ন সমন্বয়কারী যন্ত্র।

চিকিৎসা সরঞ্জাম: রেসপিরেশন মনিটর, গ্লুকোজ মনিটর, ফিজিক্যাল থেরাপি ডিভাইস, ল্যাব মেজারমেন্ট ইকুইপমেন্ট, ডিফাইব্রিলেটর, এমআরএই ইকুইপমেন্ট, ডায়াগনস্টিক ইমেজিং ইকুইপমেন্ট, বায়োমেডিকেল/প্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষার যন্ত্রপাতি, ইউরিনালাইসিস ইকুইপমেন্ট, এন্ডোসকপির যন্ত্র, হেমাটোলজির বিভিন্ন পরীক্ষার যন্ত্রপাতি, ভাইটাল সাইন মনিটর, আলট্রাসাউন্ড ইকুইপমেন্ট, কমপিউটেড টোমোগ্রাফির যন্ত্রপাতি ও এক্সরে মেশিনারি।  

অটোমেটিক ডিসপেনসার: কোমল পানীয় বিক্রির স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র (ভেন্ডর মেশিন) এবং টাকা উত্তোলনের জন্য ব্যবহৃত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র (এটিএম)।

তথ্য প্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতি: মেইনফ্রেম কম্পিউটার, মিনি কম্পিউটার, ব্যক্তিগত কম্পিউটার, কম্পিউটার মনিটর, ল্যাপটপ কম্পিউটার, নোটবুক বা নোটপ্যাড, প্রিন্টার, ফটোকপিয়ার, ক্যালকুলেটর, ফ্যাক্স, সেলুলার ফোন বা মোবাইল ফোন, টেলিফোন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি যা বৈদ্যুতিক পদ্ধতিতে তথ্য বা ছবি সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং উপস্থাপনা ও প্রেরণে ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তফা জব্বার বলেন, “আমরা ইলেকট্রনিক পণ্য যখন থেকে ব্যবহার শুরু করেছি, তখন থেকেই এই বর্জ্য হচ্ছে, তা পরিবেশ ও মানুষের ক্ষতি করছে, কিন্তু সব সময় বিষয়টি ওভারলুক করা হয়েছে।”

সরকার এখন বিধিমালা করার উদ্যোগ নিলেও তা চূড়ান্ত করার আগে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করার ওপর জোর দেন তিনি।

“৫০ বছরে এসে যদি বিধিমালা করে, তবে আইন করবে কবে? আর তা বাস্তবায়নই বা করবে কবে? আমার ধারণা উনারা ইন্ড্রাস্টির সঙ্গে এখনও কোনো আলোচনা করেননি।”

যেভাবে কার্যকর

# খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রির সময় প্রত্যেক প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান ভোক্তার কাছ থেকে পণ্যের মূল্যের সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ অর্থ জানামন রাখবে এবং ই-পণ্যের মেয়াদ পূর্ণ হলে বা ব্যবহার শেষে ভোক্তার কাছ থেকে তা ফেরত নেবে। ভোক্তাকে সে সময় জামানতের অর্থ প্রচলিত হারে সুদসহ ফেরত দিতে হবে।

# প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারীকে তাদের উৎপাদিত পণ্য ই-বর্জ্যে পরিণত হওয়ার পর পুনঃব্যবহারের উপযোগী বা ধ্বংস করার জন্য সংগ্রহ করতে হবে।

# ইলেকট্রিক পণ্য প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারীকে ধ্বংসপ্রাপ্ত ইলেকট্রিক্যাল পণ্য রাখার জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা সমন্বিতভাবে সংগ্রহকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।

# দেশে ই-বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বা পুনঃব্যবহারোপযোগীকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে তা বিদেশে রপ্তানি করা যাবে।

# খসড়া অনুযায়ী, ই-বর্জ্য ধ্বংস বা পুনঃব্যবহার উপযোগী করতে প্রত্যেক ই-বর্জ্য প্রস্তুতকারক, ব্যবসায়ী বা দোকানদার, মজুদকারী, পরিবহনকারী, মেরামতকারী, সংগ্রহকেন্দ্র, চূর্ণকারী, পুনঃব্যবহারউপযোগীকরণকারী, নিলাম বিক্রেতা এবং রপ্তানিকারককে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিতে হবে।

# শর্ত ভঙ্গ করলে নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিল হওয়া ছাড়াও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড দেওয়া যাবে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে দুই বছরের কারাদণ্ড বা দুই থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

খসড়ায় বলা হয়েছে, বিধিমালা বাস্তবায়নের প্রথম বছর প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারীকে তাদের উৎপাদিত ই-বর্জ্যের ১৫ শতাংশ ফিরিয়ে নিতে হবে।

দ্বিতীয় বছরে ২৫ শতাংশ, তৃতীয় বছরে ৩৫ শতাংশ এবং চতুর্থ বছরে ই-বর্জ্যের ৫৫ শতাংশ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।

কোনো ইলেকট্রনিক পণ্যের প্রস্তুতকারী বা সংযোজনকারীকে অর্থবছর শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ই-বর্জ্য সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদন পরিবেশ অধিদপ্তরে জমা দিতে হবে।

এছাড়া ই-বর্জ্য সংগ্রহ, বিক্রয়, হস্তান্তর, মজুদ এবং বিভাজন সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে তা পরিবেশ অধিদপ্তরের তদন্তের জন্য উপস্থাপন করতে হবে।

বিধিমালা অনুযায়ী, প্রস্তুতকারক, ব্যবসায়ী বা দোকানদার, সংগ্রহকেন্দ্র, চূর্ণকারী, মেরামতকারী এবং পুনঃব্যবহারোপযোগীকরণকারী ই-বর্জ্য ১২০ দিনের বেশি মজুদ রাখতে পারবে না।

এছাড়া ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য নিবন্ধন পদ্ধতি, স্থগিত ও বাতিল, পরিবেশ ছাড়পত্র গ্রহণ; ই-বর্জ্য মজুদকরণ, পরিবহন ও রপ্তানি; দুর্ঘটনাজনিত প্রতিবেদন দাখিল ও পরবর্তী কার্যক্রম, ই-বর্জ্য প্রস্তুতকারক, সংগ্রহকেন্দ্র, পরিবহনকারী, চূর্ণকারী, মেরামতকারী ও ব্যবহারউপযোগীকারণকারীর দায় নির্ধারণ ছাড়াও বার্ষিক প্রতিবেদন এবং ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনে বিপদজনক পদার্থ ব্যবহারের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে বিধিমালায়।