‘পরিকল্পনার অভাবে সংযোজনে আটকে বাংলাদেশ’

পোশাক বয়ন আর যন্ত্রাংশ সংযোজনে আটকে না থেকে নিজস্ব নকশায় জোর দিয়ে যন্ত্রশিল্পে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে গেলেন উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ে কর্মরত এক বাংলাদেশি প্রকৌশলী।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Jan 2017, 04:05 PM
Updated : 28 Jan 2017, 04:05 PM

ঢাকায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার উড়োজাহাজ নির্মাণ কৌশল বিষয়ক এক সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে যন্ত্রাংশ তৈরির পাশাপাশি এ শিল্পে বাংলাদেশের সম্ভাবনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন প্রকৌশলী আশরাফ আলী।

তিনি বলছেন, সরকারের পরিকল্পিত উদ্যোগ থাকলে বাংলাদেশেও উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ কিংবা ইঞ্জিনের মতো সরঞ্জাম বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা সম্ভব।

আর এজন্য জাহাজ ও মোটর সাইকেলের মতো প্রকৌশল পণ্য সংযোজনের (অ্যাসেম্বলিং) মধ্যে আটকে না থেকে নিজস্ব নকশায় নির্মাণ শুরু করা প্রয়োজন বলে মত দেন আশরাফ।

তিনি বলেন, “আমাদের দেশে শিপ বিল্ডিংয়ের কাজ হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে, ইদানিং মোটর সাইকেল তৈরি শুরু হয়েছে। শুরু থেকেই সম্পূর্ণ দেশীয় পরিকল্পনায় এ কাজগুলো করতে পারলে অনেক দূর এগোনো যেত। কিন্তু আমরা সেটা না করে কেবলমাত্র অ্যাসেম্বলিংয়ে সীমাবদ্ধ থেকেছি।

“শিপ বিল্ডিংয়ের ডিজাইনগুলো আসছে জার্মানি থেকে। এখানে শুধু ভারী কাজগুলো হচ্ছে, তাহলে আমরা আর শিখতে পারছি না। শিখতে হলে অবশ্যই কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতে হবে।”

ঝিনাইদহের সন্তান আশরাফ আলী ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করে দুই বছর পর উচ্চতর পড়াশোনার জন্য পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে; সেখানে নিউ ইয়র্কের রেনেসেলার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে এমএস ডিগ্রি নেন ১৯৮৩ সালে।

এরপর যুক্তরাষ্ট্রে এএনএসওয়াইএস নামের একটি কোম্পানিতে বিভিন্ন প্রকৌশল শাখায় ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ১০ বছর কাজ করেন।

সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৯৭ সালে যুক্ত হন উড়োজাহাজ তৈরির শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি বোয়িংয়ে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভিন্ন শাখায় কাজ করার পাশাপাশি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা বিভাগেও কাজ করেন আশরাফ। বর্তমানে বোয়িংয়ের জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত আছেন তিনি।

যেকোনো যন্ত্রাংশ নির্মাণে নকশা প্রণয়ন (ডিজাইনিং) ও ‘প্ল্যানিং’ মূল কাজ জানিয়ে এসব কাজে দেশের প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ তৈরির ওপর জোর দেন বুয়েট থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়া এই প্রকৌশলী।

“এজন্য (ডিজাইনিং ও প্ল্যানিং) প্রচুর ম্যাথমেটিক্যাল প্রবলেম সলভ করতে হয়। একটি যন্ত্রের ডিজাইনে যে পরিমাপগুলো আছে সে বিষয়ে দক্ষ হতে হবে। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং, ট্রিপল-ইর শিক্ষার্থীদেরকে সে ধরনের কাজের সুযোগ করে দিতে হবে।”

ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ প্রতিবেশী দেশগুলো প্রকৌশল পণ্যে নিজেরা নকশা ও পরিকল্পনা আগে থেকে শুরু করার কারণেই এগিয়ে যেতে পেরেছে বলে আশরাফ আলীর ভাষ্য।

“এখন আমাদেরকেও সেই পথে হাঁটতে হবে, কারণ পরের কাজগুলো ওই ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করেই সামনে এগোয়। ইন্ডিয়া অনেক আগ থেকেই দেশীয় ভার্সন সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে আসছে। আজ সেকারণে তারা উড়োজাহাজের বেশ কিছু পার্টস তৈরি করতে পারছে।

“চীন, কোরিয়া, জাপানের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি এসেছে তাদের নিজস্ব প্রচেষ্টার ফলে। কিন্তু বাংলাদেশে সুযোগ ও প্রয়োজন সৃষ্টি হলেও সরকার সেই কাজটি এখনও শুরু করেনি।”

অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের পথে থাকা বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে শিল্প কারখানা স্থাপনের প্রবণতা বেশ লক্ষণীয় পর্যায়ে রয়েছে বলে নিজের পর্যবেক্ষণের কথা জানান প্রকৌশলী আশরাফ আলী।

তবে নিজস্ব উদ্ভাবনে পিছিয়ে থাকার পেছনে সরকারের ‘নীতির (পলিসি) সমস্যার’ পাশাপাশি অনেক সরকারি কর্মকর্তার মধ্যে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রবণতাকে দায়ী করেন তিনি।

“প্রথমত এখানে যন্ত্রাংশ নির্মাণে যে কাঁচামাল প্রয়োজন তা আমদানির ওপর মোটা অংকের শুল্ক বসানো আছে। অন্যদিকে এসব যন্ত্রাংশ বাইরে পাওয়া যাচ্ছে আরও কম মূল্যে। সে কারণে দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান উদ্ভাবনী পণ্যে গিয়ে ক্ষতির শিকার হতে চাইছে না।

“সরকার অতীতে ডিসকারেজ করেছে অনেক। একটা সিম্পল পার্টস বানাতে যে ‘র মেটেরিয়াল’ লাগবে সেখানে দেড়শ পার্সেন্টের মতো ট্যাক্স বসিয়েছে। এ কারণে বিদেশি পণ্য এনে ব্যবহার করতে হচ্ছে, যার বিনিময়ে সরকারি কর্মকর্তারা হয়তো মোটা অংকের টাকাও পাচ্ছে।”

অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে এ ধরনের নীতিগত ও আমলাতান্ত্রিক সমস্যা দেখা যায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কিন্তু যারা এই ধারা থেকে বেরিয়েছে, যেমন সিঙ্গাপুর, ভারত, কোরিয়া, তারা এর সুফল পাচ্ছে।”

বোয়িংয়ের উদাহরণ তুলে ধরে প্রকৗশলী আশরাফ বলেন, ‍“এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বোয়িং তার যন্ত্রাংশ আউট-সোর্সিং করছে। বাংলাদেশ পশ্চিমা বিশ্বের গার্মেন্টস পণ্য যেভাবে করে দিচ্ছে, চাইলে একইভাবে ভারী যন্ত্রাংশের চেইনের সঙ্গেও যুক্ত হতে পারে।”

এজন্য নীতিগত ও আমলাতান্ত্রিক সব সমস্যা দূর করার পাশাপাশি দেশের মেধাবী তরুণদের এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার ওপর জোর দেন প্রবাসী এই প্রকৌশলী।