সরকারের পাওনা পৌনে পাঁচশ কোটি পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় বন্ধ হয়ে গেল বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল ফোন অপারেটর সিটিসেল।
Published : 20 Oct 2016, 05:10 PM
বৃহস্পতিবার বিকালে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসির কর্মকর্তারা র্যাব-পুলিশ নিয়ে রাজধানীর মহাখালীতে কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়ে ঢুকে বন্ধের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন।
তার মধ্যেই এক সংবাদ সম্মেলনে টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম জানান, বিটিআরসির পাওনা না দেওয়ায় সিটিসেলের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপি নেতা মোরশেদ খানের মালিকানাধীন সিটিসেল ছিল দেশের একমাত্র মোবাইল ফোন অপারেটর। ফোন সেট ও কলরেটে অতিরিক্ত উচ্চমূল্য আদায় করে একচেটিয়া ব্যবসা করে যায় এ কোম্পানি।
ওই দশকের শেষ দিকে বাজারে নতুন অপারেটর এলে প্রতিযোগিতার মুখে শুরু হয় সিটিসেলের ভাটার টান। গত কয়েক বছরে একাধিকবার সময় নিয়েও পাওনা দিতে পারেনি বলে তারা আপাতত আর তা দিতে পারবে না বলেই মনে করছেন তারানা হালিম।
“তারা সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। ব্যাংকের কাছে তারা কোটি কোটি টাকা দেনা, গণমাধ্যমগুলোতেও তারা বিজ্ঞাপনের দেনা পরিশোধ করেনি। এই সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হয়ে আসতে চাই।”
কমতে কমতে সিডিএমএ অপারেটর সিটিসেলের গ্রাহক দেড় লাখে এসে ঠেকেছে। তবে এই গ্রাহকরা কোনো ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না বলেই বিটিআরসি চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদের কথায় স্পষ্ট। সিটিসেলের কর্মীদের বিষয়েও কোনো উত্তর মেলেনি।
বিটিআরসি কার্যালয়ে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে থাকা শাহজাহান মাহমুদ গ্রাহকদের বিষয়ে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসায় বলেন, “কোম্পানি নেই, ক্ষতিপূরণ আদায় হবে কীভাবে?”
সিটিসেল গ্রাহকদের অন্য কোম্পানিতে চলে যেতে বিটিআরসির পক্ষ থেকে দুবার সময় দেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আকস্মিকভাবে মহাখালীতে সিটিসেলের প্রধান কার্যালয় প্যাসিফিক সেন্টারে র্যাব-পুলিশ নিয়ে বিটিআরসির অভিযানের সময়ই জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আসেন প্রতিমন্ত্রী তারানা।
বিকাল পৌনে ৫টার দিকে বিটিআরসির পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) এয়াকুব আলী ভূইয়া সিটিসেলের প্রধান কার্যালয়ে ঢুকলেও সংস্থার কোনো কর্মকর্তা মুখ খুলছিলেন না।
সংবাদ সম্মেলনে এসে তারানা বলেন, “বিটিআরসির বকেয়া না দেওয়ায় সিটিসেলের তরঙ্গ স্থগিত করা হয়েছে।
“আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করে আপিল বিভাগের রায় অনুসারে আইন অনুযায়ী বিটিআরসির ক্ষমতাবলে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
পাওনা না পেয়ে গত জুলাই মাসে সিটিসেলের কার্যক্রম বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বিটিআরসি)। পরের মাসে তাদের নোটিস দেওয়া হয়েছিল।
ওই নোটিসের পর সিটিসেল আদালতে গেলে আপিল বিভাগ টাকা পরিশোধ সাপেক্ষে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সিটিসেলকে দুই মাস সময় দিয়েছিল। গত ২৯ অগাস্ট আদালতের ওই আদেশ হয়।
বিটিআরসির আইনজীবী খন্দকার রেজা-ই-রাকিব সেদিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ১৭ অগাস্টের আগ পর্যন্ত সিটিসেলের কাছে বিটিআরসির পাওনা রয়েছে ৪৭৭ কোটি টাকা। এর দুই তৃতীয়াংশ এখন থেকে এক মাসের মধ্যে, আর এক তৃতীয়াংশ পরবর্তী এক মাসে পরিশোধ করতে হবে।
“তাছাড়া ১৭ অগাস্টের পর থেকে প্রতিদিন বিটিআরসি আরও ১৮ লাখ টাকা করে পাওনা হচ্ছে। প্রতিদিনের এই টাকা অবিলম্বে পরিশোধের নির্দেশ দিয়ে আদালত বলেছে, টাকা না পেলে বিটিআরসি যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে।
প্রতিমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ৪৭৭ কোটি টাকার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ৪ সপ্তাহের মধ্যে দেওয়ার কথা ছিল। তবে তারা সে টাকা পরিশোধ করেনি।
“তারা আজ মাত্র ১৩০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। প্রথম পর্যায়ে তাদের ৩১৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা পরিশোধের কথা ছিল।”
>> ১৯৯০ সালে হংকং হাচিসন টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে বিটিএল নাম বদলে হয় হাচসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (এইচবিটিএল)।
>> ১৯৯৩ সালে শুরু হয় এইচবিটিএল এর মোবাইল সেবা কর্যক্রম।
>> ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় আবার পরিবর্তন আসে। বিএনপি নেতা মোরশেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক মটরস ও ফারইস্ট টেলিকম মিলে এইচবিটিএল-এর শেয়ার কিনে নেয়। কোম্পানির নাম বদলে হয় প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড, ব্র্যান্ডিং শুরু হয় সিটিসেল নামে।
>> ২০০৪ সালে এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে সিঙ্গাপুরভিত্তিক সিংটেল এশিয়া প্যাসিফিক ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। নিজের শেয়ারের একটি বড় অংশ সিংটেলের কাছে বিক্রি করে বড় অঙ্কের মুনাফা করে নেন মোরশেদ খান।
>> সিটিসেলের ওয়েবসাইটের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই কোম্পানির ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক মোরশেদ খানের প্যাসিফিক মোটরস লিমিটেড। সিংটেলের হাতে আছে ৪৫ শতাংশ শেয়ার। এছাড়া ফার ইস্ট টেলিকম লিমিটেড ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক
সিটিসেল কর্মকর্তারা এর আগে বলেছিলেন, তারা নতুন বিনিয়োগের আলোচনা করছেন। অর্থ এলে দেনা পরিশোধ করে টিকে থাকবেন তারা।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “তারা ১১ বার বিনিয়োগ নিয়ে আসছে বলে জানিয়েছিল, তবে তারা আনতে পারেনি। তাদের উপর আস্থা রাখা যায় না। তারা কাজে দেখাতে পারেনি।”
বকেয়া আদায়ে পরবর্তীতে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তারানা হালিম।
টাকা পরিশোধ করলে তরঙ্গ ফেরত দেওয়া হবে কি না- সাংবাদিকদের প্রশ্নে তারানা বলেন, “সিটিসেলের ব্যাক করার কোনো সুযোগ দেখছি না। প্রাথমিকভাবে তারা বকেয়া টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে।”
সিটিসেলের তরঙ্গ বাতিল করা হবে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটি একটি শব্দগত ব্যাপার, তরঙ্গ বাতিলের সিদ্ধান্তও হতে পারে।”
সিটিসেল আদালতে গিয়ে পক্ষে আদেশ পেতে পারে কি না- প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রীর উত্তর, “আমার মনে হয় আদালতে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। এটি আর ঠিক করা সম্ভব নয়। মনে হয়, এটিই চিরস্থায়ী হয়ে যাবে।”
সিটিসেলের তরঙ্গ স্থগিতের পর নতুন কোনো অপারেটর নিয়ে আসার আপাতত কোনো চিন্তাভাবনা সরকারের নেই বলে জানান তারানা।
বর্তমানে বাংলাদেশে পাঁচটি মোবাইল ফোন অপারেটের গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি, এয়ারটেল ও রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিটক সক্রিয়। এরমধ্যে রবি ও এয়ারটেল এক হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সব মিলিয়ে সিম গ্রাহকের সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি।
বিটিআরসি চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান, সিটিসেলের কর্মীদের ক্ষতিপূরণ বা অন্যান্য সুবিধা আদায়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না?
“এ বিষয়ে কর্মচারীরা বিটিআরসিতে সময়মতো আসেনি। সময়মতো আসলে হয়ত কিছু করা যেত।”