গুলশান হামলার কালো ছায়া রেস্তোরাঁ ব্যবসায়

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর রাজধানীর অভিজাত এলাকার হোটেল- রেস্তোরাঁয় কমে গেছে লোকজনের আনাগোনা; দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কয়েকটি অনুষ্ঠান বাতিল হওয়ায় আবাসিক হোটেল ও সম্মেলনকেন্দ্রে কমেছে অতিথির সংখ্যা।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 July 2016, 06:01 AM
Updated : 20 July 2016, 06:49 AM

ঢাকার গুলশান, বনানীসহ কয়েকটি এলাকায় ঘুরে বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ও ক্যাফের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।

গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের উপদেষ্টা এবং ১২৩ নম্বর সড়কের ৫৫ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা রাফেজ আলম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,  স্থানীয় লোকজনের আতঙ্ক এখনো কাটেনি। খুব প্রয়োজন না হলে বাইরের লোক আর গুলশানমুখো হচ্ছেন না।

“গুলশানের রেস্তোরাঁ ও শপিং মলগুলোয় অন্য এলাকার লোকজন আসছে না আতঙ্কের কারণে। আমরা যারা গুলশানের বাসিন্দা তাদেরতো কাজের প্রয়োজনে বাইরে বেরুতে হয়। আমরাও বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছি।”

গুলশান ২ নম্বর সেকশনের ৭৯ নম্বর সড়কে ১০ কাঠার প্লটের উপর দোতলা ভবনে গড়ে ওঠা হলি আর্টিজান বেকারি বিদেশিদের কাছে জনপ্রিয় ছিল। লেকের ধারের এই ক্যাফের খোলা লন ছিল। সেখানে বিদেশি অনেকে চাদর বিছিয়ে রোদ পোহাতেন, শিশুদের খেলার পর্যাপ্ত জায়গাও ছিল।

গত ১ জুলাই রাতে একদল অস্ত্রধারী তরুণ সেখানে ঢুকে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। তাদের মোকাবেলায় গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। এরপর জঙ্গিরা ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে। পরদিন সকালে কমান্ডো অভিযান চালিয়ে ওই রেস্তোরাঁর নিয়ন্ত্রণ নেয় নিরাপত্তা বাহিনী।

ওই ঘটনার পরই অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোয় লোকজনের যাতায়াত কমে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন। 

গুলশান দক্ষিণ এভিনিউয়ের ভিলেজ রেস্তোরাঁ দেশি-বিদেশি অতিথিদের ভিড়ে জমজমাট থাকত সবসময়।মঙ্গলবার দুপুরে সেখানে দেখা যায় সুনসান নীরবতা।  

এ রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক মেহেদি হাসান জানান, ৩০০ জনের ধারণ ক্ষমতার মোটামুটি ৭০ শতাংশ পূর্ণ হত প্রতিদিন। গড় হিসাব ধরলে এরমধ্যে ৩০ ভাগ করপোরেট, ৩০ ভাগ ‘ওয়াকিং’ এবং ১০ ভাগ বিদেশি অতিথি থাকতেন। গুলশান হামলার পর আসনের ২০ শতাংশও পূর্ণ হয় না। বিদেশি অতিথিরা পারতপক্ষে আসেন না।

“আমরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছি। কিন্তু কেউ আসতে সাহস পাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে বুফে লাঞ্চ বন্ধ করে দিয়েছি। পার্টি রিজার্ভেশনও নিচ্ছি না।”

একই অবস্থা গুলশানের কফি শপগুলোর। গ্লোরিয়া জিন’স কফিজের গুলশান শাখায় দেখা যায় নিরাপত্তার কড়াকড়ি। অতিথিদের সবাইকে ঢোকানো হচ্ছে তল্লাশি করে। 

প্রগতি সরণির নর্থ এন্ড কফি শপেও ক্রেতাদের ভিড় আর আগের মত নেই বলে জানালেন শিফট ইনচার্জ আতাউর রহমান।

“এখন বিদেশিরা তো আসেই না। স্থানীয়রাও আসতে ভয় পায়।”

এ কফি শপে আসা বারিধারার বাসিন্দা শাহরিয়ার আহম্মেদ ও হৃদি রেজা জানান, গুলশান হামলার পর বাইরে বের হওয়া কমিয়ে দিয়েছেন তারা।

গুলশানের রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় জড়িত ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েকজনের নাম আসার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উগ্রপন্থা ছড়ানোর বিষয়টি আলোচনায় আসে

“সবাই আসলে খুব ভয়ে আছি। অভিভাবকরাও টেনশনে থাকেন। আমাদের বন্ধুরাও কেউ খুব একটা বাইরে যায় না।”

বনানীর ১১ নম্বর সড়কের ক্যাফে দ্রুমে এমনিতে সন্ধ্যার পর লোকজনের ভিড় থাকে। তবে সে চিত্র পাল্টে গেছে বলে জানালেন ক্যাফের ব্যবস্থাপক আবু বকর সিদ্দিক।

“গুলশান-বনানী ছাড়াও রাজধানীর অন্য এলাকা থেকে অতিথিরা আমাদের এখানে আসেন। এখন এদিকে আসতে হলে কয়েক দফা পুলিশের তল্লাশির মুখে পড়তে হয়। ঝামেলা এড়াতে অনেকেই আসেন না।”

এ রেস্তোরাঁয় আসা বনানীর ২ নম্বর সড়কের এক বাসিন্দা বললেন, তিনি ঘরে বসে থাকতে রাজি নন। নিজের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান ঢাকায় একটি দূতাবাসের এই কর্মকর্তা।

“একটা আতঙ্ক আছে, তারপরও হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো হবে না। বের হতে হবে।”

অবশ্য বনানীর ৬ নম্বর সড়কের টেক আউট রেস্তোরাঁয় ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেছে । আতঙ্ক না ছাড়লেও ১৫ নম্বর সড়কের বাসিন্দা আবদুর রহমান পরিবার নিয়ে মঙ্গলবার খেতে গিয়েছিলেন সেখানে।

“আমরা সবাই খুব ভয়ে আছি। কখন কী হয় বলা তো যায় না।”

গুলশান হামলার পর রাজধানীর বিভিন্ন কনভেনশন হলে পুর্বনির্ধারিত অনেক অনুষ্ঠানও বাতিল হয়েছে।

স্পেকট্রা কনভেনশন সেন্টারের ব্যবস্থাপক মো. আরিফ শিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ঈদের পর ১৮ জুলাই পর্যন্ত ১৬টি অনুষ্ঠান সেখানে হয়েছে। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে নয়টি অনুষ্ঠান বাতিল করে দিয়েছেন আয়োজকরা।

তিনি জানান, লন্ডনে বসবাসকারী ছেলের বিয়ে জন্য স্পেকট্রায় হল ভাড়া করেছিলেন ঢাকার একজন ব্যবসায়ী। কিন্তু ভিসা জটিলতায় অনুষ্ঠানও আটকে গেছে।

“আমরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছি। সিসি ক্যামেরা বসিয়েছি, প্রত্যেককে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করে হলে ঢোকানো হয়। তবে লোকজনের আস্থা না ফিরলে পরিস্থিতি পাল্টাবে না।”

ঢাকা রিজেন্সি হোটেলের একজন কর্মকর্তা জানান, ঈদের পর মানি লন্ডারিং ও টেলিযোগাযোগ বিষয়ে সম্মেলন এবং আমেরিকান দূতাবাসের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। এসব সম্মেলনের অতিথিদের জন্য ঢাকার বড় হোটেলগুলোতে ১২০০ কক্ষের রিজার্ভেশনও নেওয়া হয়েছিল। গুলশানের ঘটনার কারণে নিরাপত্তাজনিত কারণে সম্মেলন বাতিল হওয়ায় রিজার্ভেশনও বাতিল হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে রিজেন্সির ওই কর্মকর্তা জানান, তাদের হোটেলে ঈদের পর নির্ধারিত ১০টি অনুষ্ঠানের মধ্যে আটটির তারিখ পেছানো হয়েছে; দুটি বাতিল করা হয়েছে।

“অভিজাত হোটেলগুলোয় বেশিরভাগ অনুষ্ঠান হয় বিদেশিদের জন্য। তারা না আসতে পারলে অনুষ্ঠান হবে কী করে?”

ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার মোশতাক আহমেদ বলছেন, নাগরিকদের আস্থা ফেরাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ‘প্রয়োজনীয় সবকিছুই’ করছে।

অভিজাত এলাকায় শিগগিরই আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফেরার আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি। দিনে-রাতে টহল দেওয়া হচ্ছে। আমরা হোটেল রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোকজনের সঙ্গে পরামর্শ করছি।”

এরপরও বিদেশিরা বাড়তি নিরাপত্তা চাইলে তা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।