বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করে তিনি বলেন, “ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা সুদৃঢ় কার জন্য একটি ব্যাংক কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা আমরা দীর্ঘদিন শুনে আসছি। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।”
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার খেলাপি ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের (রাইট অফ) স্থিতি ছিল ৩৯ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ যোগ করলে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ৫০ হাজার ১২২ কোটি টাকা।
ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং কয়েকটি ব্যাংকে অনিয়মের ঘটনায় এ খাতের জন্য একটি কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ।
২০১৬ সালে তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ব্যাংক খাতকে আরও বেশি নজরদারির মধ্যে আনতে একটি কমিশন গঠনে কাজ শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এরপর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বলেন, ওই কমিশন তিনি গঠন করবেন সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে। কিন্তু ২০১৮ সালে সরকারের শেষ বছরের বাজেট দিয়ে তিনি বলেন, ওই মেয়াদে আর ব্যাংক কমিশন হচ্ছে না।
“বলেছিলাম ব্যাংকিং খাতের জন্য অদূর ভবিষ্যতে কমিশন করব। না, ব্যাংকিং কমিশন হচ্ছে না। ব্যাংকিং কমিশন করার সমস্ত কাগজপত্র তৈরি করে রেখেছি, আমি এটা পরবর্তী সরকারের কাছে দিয়ে যেতে চাই, পরবর্তী সরকার কে হবে তার উপর নির্ভর করবে সংস্কার।”
একাদশ সংসদ নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় এসেছে। মুহিত রাজনীতি থেকে অবসরে গেছেন, তার জায়গায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে এসেছেন মুস্তফা কামাল।
বছরের শুরুতে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, খেলাপি ঋণ আর ‘এক টাকাও বাড়বে না’। সেজন্য ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিলসহ কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর সে কথা ফলেনি, খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।
বৃহস্পতিবার নতুন অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থান করে তিনি বলেন, “ব্যাংক খাতে শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কোনো প্রকার সংস্কার আমরা লক্ষ্য করি নাই। ব্যাংক থেকে কোনো ঋণগ্রহিতা ঋণ গ্রহণ করে ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে তার জন্য কোনো প্রকার এক্সিটের ব্যবস্থা ছিল না।
“আমরা এবার এ কা্যক্রমটি আইনি প্রক্রিয়ায় সুরহা করার লক্ষ্যে একটি কার্যকর ইনসলভেন্সি আইন ও দেউলিয়া আইনের হাত ধরে ঋণ গ্রহিতাদের এক্সিটের ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
ব্যাংক, পুঁজিবাজার, বীমা ও অন্যান্য আর্থিক খাতের সংস্কার ও উন্নয়নে সরকার নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আমরা লক্ষ্য করে আসছি আমাদের আর্থিক খাতে বিশেষ কোনো ইন্সট্রুমেন্টের ব্যবহার ছিল না। তাই ব্যাংকসমূহ স্বল্প মেয়াদের আমানত সংগ্রহ করে দীর্ঘ মেয়াদের ঋণ দিতে বাধ্য হত। এতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়।
“এটা কখনো কখনো সংকট সৃষ্টি করে থাকে। এই জাতীয় ভারসাম্যহীন অবস্থা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। একটি গতিশীল বন্ড মার্কেটসহ অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্ট- যেমন ওয়েজ আর্নার্স বন্ড, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, ট্রেজারি বন্ড- ইত্যাদির ব্যবহার উৎসাহিত করব।”
আর্থিক খাতে কী ধরনের সংস্কার করা হবে তারও একটি ধারণা তিনি বাজেট প্রস্তাবে দেন।
মুস্তফা কামাল বলেন, “পর্যায়ক্রমে আমরা ব্যাংকের মূলধনের পরিমাণ বাড়াব। ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংশোধন আনব, যাতে আমাদের ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার অঙ্গসমূহ যথা- ভ্যাট, কাস্টমস এবং আয়কর সংক্রান্ত আইনসহ অন্য কোনো আইনের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়।”
দুটি ব্যাংককে একীভূত করার প্রয়োজন হলে সেজন্য আইনি পথ তৈরি করতে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হবে বলে জানান তিনি।
হোল্ডিং কোম্পানি এবং সাবসিডারি কোম্পানির কার্যক্রম যুগোপযোগী করাও এ আইন সংশোধনের একটি উদ্দেশ্য বলে অর্থমন্ত্রী জানান।
তিনি বলেন, “যেসব ঋণগ্রহিতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন পরিশোধ না করার জন্য (ইচ্ছাকৃত খেলাপী) সেই সমস্ত ঋণগ্রহিতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
“দেশের শিল্প ও ব্যবসা খাতকে প্রতিযোগিতা সক্ষম করার লক্ষ্যে আমরা ব্যাংক ঋণের উপর সুদের হার এক অংকের ওপর দেখতে চাই না। এই লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।”