দ্রুত গতির বাস-ট্রাকের বেসামাল চলাচলে প্রতি মুহূর্তে দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়েই পথে নামেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার নানা বয়স ও পেশার বাসিন্দারা।
ভারী যান তো রয়েছেই, ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌড়াত্ম্য নিয়েও অভিযোগ রয়েছে নগরীর দিদার মার্কেট, কাজেম আলী রোড, ঘাটফরহাদবেগ, আন্দরকিল্লা জেমিসন মেটারনিটি, টেরিবাজার মোড়ে চলাচলকারীদের।
দেশে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী চিন্তা ও লোডশেডিং চলার মধ্যেই চট্টগ্রামে এসব অলিগলিতে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যযন্ত ব্যাটারিচালিত রিকশার জট লেগেই থাকে; বেপরোয়া গতির কারণে ঘটে দুর্ঘটনাও।
এসবে অফিসগামী মানুষের যেমন সমস্যা হয়, তেমনি অসুবিধা বোধ করেন স্কুল শিক্ষার্থীরাও। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র তীর্থ জানালেন সে কথা।
তীর্থ বলেন, “আমার মর্নিং শিফটে স্কুল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছুটতে হয়। মটর রিকশাগুলো জটলা লেগে থাকে, তার উপর এমন গতিতে চলে, পাশ কাটিয়ে স্কুল বাস ধরাও কষ্টের হয়।”
ব্যাটারিচালিত রিকশার অলিখিত স্ট্যান্ডে আন্দরকিল্লা মোড়ের জেমিসন মেটারনিটিতে আসা রোগী ও স্বজনদেরও পড়তে হয় ভোগান্তিতে।
ব্যাটারিচালিত এসব রিকশা চলাচলে নিষেধ আছে জানার পরেও এই বাহন চালান জুলহাস মিয়া।
তিনি বললেন, ”মেইন রোডে উঠি না, ভিতরের রাস্তায় চালাই। জানি নিষেধ আছে।
”মালিক জমা বেশি নিলেও আয় ভাল হয়। দুরবস্থায় কোনো রকমে চলতে পারি।”
এদিকে ফিরিঙ্গীবাজার হয়ে কর্ণফূলী সেতু পর্যন্ত মেরিনার্স সড়ক হওয়ায় পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত ও অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচলে ঝুকিঁপূর্ণ হয়ে উঠেছে কোতোয়ালীর মোড়, পাথরঘাটা, আলকরণ, সদরঘাট, আইস ফ্যাক্টরি রোড এবং আশেপাশের এলাকা।
পাথরঘাটা এলাকার বাসিন্দা গার্মেন্টস কর্মী ফাতেমা বেগম বলেন, ”কোতোয়ালির মোড় এলাকায় মোটামুটি সব রকমের যানবাহন চলে। যথাসময়ে অফিস যেতে সুবিধা হয়।
“কিন্তু এমন দ্রুতগতিতে চলে যেন রাস্তা পারাপারে ঝুঁকি নিতে হয়। তাই এই মোড়ে একটা ফুটওভার ব্রিজ হলে খুব ভালো হতো।”
আলকরণ হয়ে সদরঘাট এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, ডায়গনস্টিক সেন্টার, মন্দির, মসজিদ, ব্যাংক-বীমা অফিস, সাইকেল-সাইকেল পার্টস-বিভিন্ন রকমের বেয়ারিংয়ের পাইকারি বাজার সহ বেশ কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এদিকে নিউ মার্কেট এলাকায়ও রয়েছে অনেক দোকানপাট-প্রতিষ্ঠান।
বন্দর নিকটবর্তী হওয়ায় বন্দরের বিভিন্ন মালামাল নিয়ে এই সড়কগুলোতে ট্রেইলার, লরি, বড় বড় ট্রাক, কভার্ড ভ্যান চলাচল করে বেপরোয়া গতিতে। সড়কের দুপাশের বিস্তৃত আবাসিক এলাকার লোকজনের জন্য যা চিন্তার বিষয়।
সকাল থেকে রাত অব্দি থেমে থেমে জট লেগেই থাকে এই এলাকায়। অফিস এবং স্কুল-কলেজগামীদের পড়তে হয় ভোগান্তিতে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. দিলীপ চৌধুরী বলেন, ”আমার বাসা ও চেম্বার এই এলাকায়। প্রায় যেভাবে অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচল করতে দেখি, এতে জীবনের ঝুঁকি যেমন রয়েছে, তেমনি স্বাস্থ্যঝুঁকিও।
”এই এলাকায় একটা গুরুত্বপূর্ণ মাতৃসদন হাসপাতাল রয়েছে, অথচ এলাকার শব্দ দূষণের মাত্রা অসহনীয়।”
”দেখতে দেখতেই এলাকাটা কেমন ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করাও অনেক দুরুহ”, বললেন সদরঘাট অমর চাঁদ রোডের সাইকেল পার্টস ব্যবসায়ী সোহেল আহমেদ।
কোতোয়ালি, ফিরিঙ্গীবাজার, সদরঘাট এবং এর আশপাশের এলাকা নিয়েই পুরাতন চট্টগ্রাম শহরের গোড়াপত্তন। বলা হয়, এলাকার পি কে সেন সাত তলা ভবনের আলো দেখে এক সময় মানুষ নৌপথে চট্টগ্রাম শহর চিনত।
অথচ এখন সকাল থেকে রাত পর্যযন্ত অপরিকল্পিত, অনিয়ন্ত্রিত এবং বেপরোয়া যান চলাচলের কারণে এসব এলাকার অবস্থা বিপর্যস্ত বলে জানাচ্ছেন স্থানীয়রা।
উত্তর নালাপাড়ার বাসিন্দা সঞ্জয় চৌধুরী বলেন, “সকালে মেয়ের স্কুলের জন্য বের হতেই অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই বের হই।
”নালাপাড়া থেকে বের হয়ে কোতোয়ালীর মোড় পেড়িয়ে পাথরঘাটা মেয়ের স্কুলে পৌঁছাতে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়, অথচ দূরত্ব কিন্তু বেশি না।”
মটরযানের পরিকল্পনাহীন সহজলভ্যতায় শহরের আনাচে-কানাচে পরিচ্ছন্ন জনজীবন ক্রমেই ব্যহত হচ্ছে।
আলকরণ এলাকার বাসিন্দা বিনয় ভূষণ নাথ কলেজ জীবন থেকেই এই এলাকার বাসিন্দা। তিনি এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
বিনয় ভূষণ নাথের ভাষ্যে, পরিচ্ছন্ন এই এলাকাটি যেন গত ১৫-১৬ বছর ধরে বেপরো্য়া যান্ত্রিক হয়ে উঠছে।
তিনি বলেন, ”সবচেয়ে বেশি ভয় লাগে পাশ দিয়ে স্ক্র্যাপ লোহার কোনো গাড়ি গেলে।
”কোনো রকমের প্রটেকশন ছাড়া যেভাবে এগুলো খোলা ট্রাকে এদিক ওদিক নেওয়া হয়, যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় কোনো দুর্ঘটনা।”