পঞ্চাশ বছরেও স্বীকৃতি পায়নি ভেড়ামারার শহীদ পরিবার

হাসিবুল হক
Published : 25 March 2022, 05:46 PM
Updated : 25 March 2022, 05:46 PM


অর্ধশতক আগে বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নিধনযজ্ঞের বিভীষিকার স্মৃতি স্মরণে শুক্রবার রাত ৯টায় বাতি নিভিয়ে 'ব্ল্যাক-আউট' কর্মসূচি পালন করল বাংলাদেশ। ছবি: মাহমুদ জামান অভি, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় যখন নির্বিচারে গণহত্যা শুরু হয় তখন একই সময় যশোর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসা পাকিস্তানি বাহিনী কুষ্টিয়া শহর দখলে নিয়ে কারফিউ জারি করে সাধারণ মানুষের ওপরও আক্রমণ শুরু করে।  বাংলাদেশে গণহত্যার ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারাতেও গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ভেড়ামারার মানুষজন যখন উদ্বেগ উৎকন্ঠায় তখন পাকিস্তানি সেনারা সেখানকার মানুষদের হত্যায় মত্ত ছিল।

কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা শহরের রথপাড়ার শহীদ মীর ছফিরউদ্দিন আহম্মেদের সন্তান অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মীর মোশাররফ হোসেনের ভাষ্যে, "১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী।

"আমাদের পরিবারের ২১ জন সদস্যকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। এর মধ্যে আমার আব্বা মীর ছফিরউদ্দিন আহম্মেদ ও দুই ভাই মীর আসাদুজ্জামান বাবু এবং মীর আব্দুর রশিদ দুলালকে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়। হত্যা করার আগে তাদেরকে দিয়ে কবর খোঁড়ানো হয়। এরপর বাড়ির উঠোনে একই গর্তে তিন জনকে মাটি চাপা দিয়ে চলে যায় পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগী রাজাকার বাহিনী। তিনজনের অপরাধ ছিল মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা।"

তিনি বলেন,  "আমাদের পিতা ও ভাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছে বলে হায়েনারা আমাদের বাড়িতে মর্টার শেল নিক্ষেপ করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দেয়। সবকিছু লুট করে নেওয়ার ফলে আমাদের পরিবারের যারা প্রাণে বেঁচে গেছে তারা নিঃস্ব হয়ে পড়ে।"

মীর মোশাররফ হোসেন বলেন,  "তারা চণ্ডীপুর গ্রামে আমাদের পরিবারের অন্যান্য স্বজনদেরও হত্যা করে। আমার গর্ভবতী চাচির পেটে হায়েনারা গুলি চালালে তার গর্ভের সন্তান মারা যায় কিন্তু চাচী অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।"

"মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের হত্যা ও নারী নির্যাতন ছিল পাকিস্তানি সেনাদের নির্মমতার কর্মসূচি। যারা নারী নির্যাতনকে কর্মসূচি হিসেবে বেছে নেয় তা কি জেনোসাইড হিসেবে বিবেচিত হবে না?"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর মোশাররফ বললেন,  "গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, সুপরিকল্পিত হত্যা, অগ্নিসংযোগসহ মারাত্মক অপরাধ হল আমাদের পরিবারের সঙ্গে, অথচ শহীদ হিসেবে আজও স্বীকৃতি পেল না আমার বাবা এবং দুই ভাই।

"অথচ আমরা কোনো বিশেষ সুবিধা চাই না, ভাতা চাই না; একটাই কথা রাষ্ট্র শুধু জেনে রাখুক এবং স্বীকৃতি দিক যে এই পরিবার মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের মর্যাদায় অভিষিক্ত।"

তিনি বলেন, "পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন আমাদের পরিবারের ওপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালায় তখন এই নৃশংস ঘটনা আমার তরুণ মনে যে আঘাত লেগেছে তা এখনো কাঁটার মতো বুকে বিঁধে আছে।

"যারা হিংস্র আচরণ করেছে আমাদের পরিবারের সাথে সেই ইতিহাস ভেড়ামারার মানুষ জানে।আমার বাবা এবং দুই ভায়ের কবর ভেড়ামারার গণকবর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।"

"অনেক চেষ্টা করেছি, রাষ্ট্রের কাছে আবেদন করেছি। কিন্ত কোনো ফল পাইনি। আমরা আশা করি মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন ও সহায়তা করতে গিয়ে যে সব পরিবার হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে রাষ্ট্র সেই পরিবারগুলোকে স্বীকৃতি দেবে", বলেন শহীদ পরিবারের মীর মোশাররফ হোসেন।