মেয়েদের মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নয় কোনো লজ্জা-ভয়

সুমিত বণিক
Published : 26 July 2021, 06:55 PM
Updated : 26 July 2021, 06:55 PM

বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নের ওয়ং সাই প্রু মারমা । বয়স ১৪। ক্লাস সিক্সে ওঠার সময় মাসিক সম্পর্কে তার খুব একটা জানা ছিলো না। প্রথমে মাসিক মানে সে মনে করতো স্কুলের মাসিক বেতনের কার্ড বা এমন কিছু একটা হবে! তার বান্ধবীর যখন প্রথম মাসিক হয়েছিলো, তখন সে তার বান্ধবীর কাপড়ে হঠাৎ রক্তের দাগ দেখে মনে করেছিলো, কোথাও কেটে গিয়ে হয়তো রক্ত বের হয়েছে। পরে মাসিকের কথা জানতে পেরে সে আরও ভয় পেয়েছিলো। পরবর্তীতে ঐ বান্ধবীর সাথে ক্লাসে বসতেও সে ভয় পেতো, কারণ তখন সে এই সমস্যাটাকে একটা ছোঁয়াছে সমস্যা বলে মনে করতো।

রোয়াংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের শান্তনা তঞ্চঙ্গ্যা। বয়স ১৯ বছর। মাসিকের সময় পেটব্যাথা শুরু হলে তখন সে আর শান্তিতে ক্লাস করতে পারে না। সারাক্ষণ শরীর ও মনে জুড়ে তার কেমন যেন একটা অস্বস্তি লেগেই থাকে। সে আরো জানালো যে, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্যার আগে থেকেই হয়তো তাকে নির্দিষ্ট একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসে উপস্থিত থাকার কথা বলে দিয়েছেন, কিন্তু তারও খুব ইচ্ছা করছে ক্লাসে উপস্থিত থাকতে। সেক্ষেত্রে কখনো দেখা যায় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ঐদিনই তার মাসিকও শুরু হয়ে গেলো। এর মধ্যেও নিজের খুব আগ্রহ আর স্যারের নির্দেশের কারণে ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও, তার মনে হয় ক্লাসে গিয়ে শুয়ে থাকতে। ক্লাসে থাকা পেট ব্যাথা প্রচন্ড রকমের হলে তার মনে হয়, তার কোমড়ে কেউ একটা বড় পাথর দিয়ে রাখুক, তাতে তখন তার মনে হয় কিছুটা হয়তো ভালো বোধ করবে।

এভাবেই দুই কিশোরী নারীর জীবনের একটি প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া মাসিক সম্পর্কে নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন। ঘটনাটি একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ওয়ং সাই প্রু মারমা নিজে একজন কিশোরী হয়ে জানতোই না, তার জীবনেও এমন একটি স্বাভাবিক ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে। কিংবা শান্তনা তঞ্চঙ্গ্যার ঘটনা থেকে জানা যায়, সে মাসিক চলাকালীন স্বাস্থ্যের উপসর্গের কারণে সে ঐ সময় ক্লাসে মনোযোগী হতেই পারে না, শারীরিক যন্ত্রণার কারণে তার ঐদিনগুলোতে তার পড়ালেখার ভীষণ ব্যাঘাত ঘটে।

এটি হলো বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান পার্বত্য জেলার দুটি উপজেলার দুইজন কিশোরী মেয়ের কথা। জনস্বাস্থ্য বিষয়ে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে আমার ব্যক্তিগত কর্ম অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পাহাড় কিংবা সমতল নারীর জীবনের মাসিক প্রক্রিয়ার বিব্রতকর ও কষ্টদায়ক ঘটনা বা অভিজ্ঞতাগুলো প্রায় একই রকম। তবে এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং ভৌগলিক দুর্গমতার কারণে প্রেক্ষাপটগুলো আরো বেশি করুণ হয়ে থাকে এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপকরণের ব্যবহার ও স্বাস্থ্য পরিচর্যায় অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে।

সম্প্রতি 'মেন্সট্রুয়াল হেলথ্ : এ ডেফিনেশন ফর পলিসি, প্র্যাক্টিস অ্যান্ড রিসার্চ' শিরোনামে এক গবেষণায় মাসিক স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা দেওয়া হয়। তাদের প্রত্যাশা মাসিক স্বাস্থ্যকে সংজ্ঞায়িত করার ফলে এটি মাসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অ্যাডভোকেসি, কর্মসূচি বাস্তবায়ন, পলিসি তৈরি ও গবেষণা কার্যক্রমে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এই সংজ্ঞাটি তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন টারমিনোলজি অ্যাকশন অফ দ্যা গ্লোবাল মেন্সট্রুয়াল কালেক্টিভ নামক প্রতিষ্ঠান। তাদের তৈরি সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, "মাসিক স্বাস্থ্য বলতে শুধুমাত্র মাসিক সংক্রান্ত কোন রোগব্যাধি না হওয়া বা শারীরিক সুস্থ্যতাকেই বোঝায় না, বরং মাসিক চক্র ও প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত সকল পর্যায়ে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে কল্যাণকর অবস্থাকে বোঝায়।"

এছাড়াও 'দ্যা ইমপ্যাক্ট অফ মেন্সট্রুয়াল সিম্পটমস্ অন এভরিডে লাইফ : এ সার্ভে এ্যামং ৪২,৮৭৯ ওমেন' শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে,  "৩৮% নারী মাসিক চলাকালীন সময়ে তাদের দৈনন্দিন কাজগুলো নিয়মিত করতে পারেন না এবং নারীদের মধ্যে যারা মাসিকের কারণে কাজগুলো অন্যের কাছে হস্তান্তর করতে হয়েছে তাদের মধ্যে শুধুমাত্র ৪৮.৬% নারী তাদের পরিবারের সাথে মাসিককালীন সময়ের লক্ষণগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন।" সুতরাং এই ছোট্ট তথ্যসমূহ থেকেও আমরা সহজেই আমরা মাসিক স্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপটটা কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারি।

বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য দিবস (২৮ মে)  উপলক্ষে বান্দরবানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে 'আমাদের জীবন, আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের ভবিষ্যৎ (ওএলএইচএফ)' প্রকল্পের উদ্যোগে দিবসটি পালন করা হয়েছে। গত ২৭ মে মাসিক স্বাস্থ্য দিবসের নানা বার্তা, ছবি সম্বলিত পোস্টার, ব্যানার নিয়ে সড়কে নিরব মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়।

পরবর্তীতে অনন্যা সংগঠনের সভা কক্ষে প্রশ্নোত্তর পর্ব ও এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রশ্নোত্তর পর্বে কিশোরী ও মেন্টরদের মাসিক সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দেন সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ভানু মারমা।

এছাড়াও অনুষ্ঠানে সিভিল সোসাইটি, নারী অধিকার কর্মী, সাংবাদিক প্রতিনিধি, আয়োজক স্থানীয় ৩ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার টিম লিডার, মাঠ পর্যায়ের কর্মী, কর্মকর্তা, গার্লস ক্লাবের কিশোরী এবং মেন্টররা উপস্থিত ছিলেন।

আমন্ত্রিত অতিথিরা ওএলএইচএফ প্রকল্পের এই সৃজনশীল আয়োজনকে সাধুবাদ জানান, সেই সাথে তিনি কিশোরী ও মেন্টরদের গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ প্রশ্নের জন্য তাদেরকে প্রশংসা করেন। সেই সাথে তিনি উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর প্রেক্ষিতে প্রদত্ত প্রশ্নের উত্তরগুলো সেশনের মাধ্যমে কিশোরী ক্লাবের সকল কিশোরী ও যুবতী নারীদের মাঝে ছড়িয়ে দেবার উদাত্ত আহবান জানান। অনুষ্ঠান শেষে আমন্ত্রিত অতিথিগণ উপস্থিত সকল কিশোরী ও মেন্টরদের হাতে শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে স্যানিটারি প্যাড তুলে দেন।

পরবর্তীতে ২৮ তারিখ বান্দরবান জেলার সদর, রোয়াংছড়ি, থানছি উপজেলা সমূহের ১৩টি ইউনিয়নের ৯০টি গার্লস ক্লাবে মাসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন করা হয়। কিশোরী ক্লাব কেন্দ্রিক দিবসটি পালনে মূল কর্মকান্ড ছিল- মাসিক স্বাস্থ্য দিবসের ধারণা পত্র পাঠ, নিজেদের মধ্যে মাসিক সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়, মাসিক দিবসের সিম্বোলিক ব্রেসলেট হাতে পড়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মাসিক দিবস উপলক্ষ্যে নানা সচেতনতামূলক বার্তা সম্বলিত পোস্টার তৈরি করে প্রদর্শন করে সেটি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করা। ক্লাব পর্যায়ের আয়োজনে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে কমিউনিটির স্থানীয় নেতা, অভিভাবকগণ কিছু কিছু ক্লাবের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

এই প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী ম্যামিসিং মারমা বলেন,  "মাসিক নারীর জীবনের একটি স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক এবং জৈবিক বিষয়। তবুও এ নিয়ে আমাদের রয়েছে কুসংস্কার ও নানা ভ্রান্ত ধারণা। আমরা আমাদের কিশোরী ক্লাবে কিশোরী ও নারীদের এ নিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করছি। সেই সাথে নারীর জীবনের সাথে ঘনিষ্টভাবে মিশে থাকা এই বিষয়ে পরিবারের মা, বাবা ও কমিউনিটির মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিতেও কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।

"এই প্রকল্পের কিশোরী ও নারীরা মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নিজে জানছে, এবং কিভাবে নিজেদের জীবনে এটাকে প্রয়োগ করা যায় সেটা সম্পর্কে শিখছে। কারণ মাসিক নারীর জীবনের সার্বিক সুস্থ্যতার জন্যে খুব গুরত্বপূর্ণ বিষয়। এই ক্ষেত্রে কোন প্রকার লজ্জা, ভয় কে দূর করে সঠিক তথ্য জানা ও স্বাস্থ্য সম্মতভাবে মাসিক ব্যাবস্থাপনা করার বিকল্প নেই।"

এ প্রসঙ্গে অনন্যা কল্যাণ সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক ডনাই প্রু নেলী বলেন, "মাসিক নারীত্বের পরিচয়। একটা সময় এ নিয়ে জানার সুযোগগুলো অবারিত ছিলো না। ফলে অনেকেই নারীই অস্বাস্থ্যকর মাসিক উপকরণ ব্যবহারের ফলে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। এখন তথ্য জানার ও সেবা নেওয়ার সুযোগগুলো আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।

"সেজন্য দরকার আমাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও মাসিকের সময় স্বাস্থ্যসম্মত উপকরণ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং সেই সাথে উপকরণ ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু আর্থিক যোগান দেওয়ার জন্য পরিবারের অভিভাবকদের দায়িত্বশীল আচরণ। এটা মনে রাখা দরকার, মাসিক চলাকালীন সময়ে সঠিক ও স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে মাসিক ব্যবস্থাপনা করতে পারা নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যেরই অধিকার। কারণ মাসিক স্বাস্থ্যের অব্যবস্থাপনা নারীর জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। তাই এ বিষয়ে পরিবারের পুরুষ সদস্যদেরও সমভাবে এগিয়ে আসতে হবে।"

বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য দিবস কে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশা, মাসিক স্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করে বিদ্যমান যেসকল কুসংস্কার, বদ্ধমূল ধারণা, সামাজিক রীতিনীতি, অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস রয়েছে, সেগুলো পরিবর্তিত হয়ে নারীর স্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক ও কল্যাণকর হবে। ফলে মাসিক নিয়ে কিশোরী ও নারীরা কোনো রকম লজ্জ্বা, ভয়, সংশয়বোধ করবে না, বরং তারা নারীর জীবনের এই প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক বিষয়টি মর্যাদার সাথে সুসম্পন্ন করতে সমর্থ হবে।