নকশী কাঁথার গ্রাম জয়নগর

শুভ সালাতিন
Published : 22 Oct 2020, 06:45 PM
Updated : 22 Oct 2020, 06:45 PM

যখন গ্রামে ঢুকলাম তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বাতাসে শীতল আমেজ। গ্রামের নাম জয়নগর।

নামে জয়নগর হলেও গ্রামটিকে এখনও নগর-সভ্যতা পুরোপুরি গ্রাস করেনি। গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে। বেশিরভাগই টিনের ঘর। কিছু কিছু একতলা পাকা বাড়ি চোখে পড়ে। গ্রামের বুক চিরে চলে গেছে একমাত্র পাকা সড়ক। সড়কটি বেশ উঁচু। মাসখানেক আগে বন্যায় যখন পুরো গ্রামটি প্লাবিত হয়,তখন অনেকে আশ্রয় নেয় এখানে। এখন পানি নেমে গেছে।

সড়কে দাঁড়ালে অনেক দূরে যে বিলটি দেখা যায়, তার নাম হাশরা বিল। সেখানে এখনও কোমর পানি। আমার বাড়িটি সড়ক থেকে একটু নীচে। সড়ক থেকে একটা মাটির সরু রাস্তা ঢালু হয়ে চলে গেছে বাড়ির দিকে। বাড়ির  পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে খোলা। দক্ষিণে একটা ছোট পুকুর। পুকুরের পাশেই পারিবারিক কবরস্থান। ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এখানে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন আমার বাবা-মা আর দাদা-দাদি।

কবরস্থানের ভিতর একটা জবা ফুলের গাছ। লাল ফুল ফুটে আছে। পুকুর পাড়ে দাঁড়ালে চোখের সামনে অবারিত ধানক্ষেত। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলাম। ঠাণ্ডা বাতাস যেন পরম মমতায় মুছে দিল ভ্রমণ ক্লান্তি

বাড়ির উত্তর ও পশ্চিম পাশে বেশ কয়েকটা গৃহস্থ বাড়ি; আমার প্রতিবেশী। দাদার আমল থেকেই তারা এখানে বসবাস করছে।

খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে হাঁটতে বের হলাম। বাড়ির সামনে পূর্ব প্রান্তে আরেকটা পুকুর। মাছ চাষ হয়। পুকুর পাড়ে সুপারি গাছের নীচে বাঁশের দুটি মাচা। এক মাচায় বসে নিবিষ্ট মনে কাঁথা সেলাই করছে উকিয়া বেগম। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। লাল কাপড়ের জমিনে ফুটে উঠছে দৃষ্টিনন্দন নক্শা।

নক্শী কাঁথা আমাদের প্রাচীন লোকশিল্প। 'নক্শী কাঁথা' কথাটার ব্যবহার শুরু হয় পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের 'নক্শী কাঁথার মাঠ' থেকে।

কথা প্রসঙ্গে উকিয়া বেগম জানালেন, একটি কাঁথা সেলাই করে ৫৫০ টাকা পান তিনি। একেকটা কাঁথা সেলাই করতে সময় লাগে তিন থেকে ছয় মাসের মতো।

কোনো কোনো সময় নক্শা জটিল হলে সময় লাগে আরো বেশি। কাপড় ও সুতার জোগান দেয় মূলত শহুরে ব্যবসায়ীরা। তাছাড়া অনেক এনজিও এই কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত।  এই শহুরে ব্যবসায়ীরা এবং  এনজিও গ্রাম্য নারীদের মাধ্যমে কম খরচে কাঁথা সেলাই করে শহরে নিয়ে আসে। শহরের বড় বড় মার্কেটে  শোভা পায় এই সব নক্শী কাঁথা এবং চাদর।

ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় প্রথমেই থাকে এই নক্শী কাঁথা। উচ্চমূল্যে বিক্রি হয় একেকটা কাঁথা । গ্রাম্য নারীদের হাতে বোনা নক্শী কাঁথা শোভা পায় বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত কারোও অন্দরমহলেও ।  ইউরোপের কোনো শহরে সৌখিন নাগরিকের বাসগৃহের বসার ঘরের কাঁচের ফ্রেমেও শোভা পায় এই কাঁথা।

গ্রামের নারীরা অবসর সময়ে ঘরের কাজ শেষ করে বিকেলের দিকে কাঁথা সেলাই করতে বসেন। গল্প-গুজব করতে করতেই চলে কাঁথা সেলাই।

আমি কাঁথা কেনার আগ্রহের কথা জানাতেই উকিয়া বেগম আরেক মহিলাকে ডেকে আনলেন। মহিলাটি ঘর থেকে একটি ভাঁজ করা কাঁথা নিয়ে এলেন। ভালো করে দেখানোর জন্য বেশ কয়েকজন মিলে কাঁথাটি সামনে মেলে ধরলেন তারা।

এক কথায় অপূর্ব! সূক্ষ সুতার কাজ। অনবদ্য শৈলী।  অবাক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম কাঁথার জমিনের দিকে; চোখ ফেরানো দায়।

একটু দরদাম করে অবশেষে ১৫০০ টাকায় রফা হল। এতো অল্পমূল্যে অসাধারণ একটা শিল্পকর্ম কিনতে পেরে মনটা ভালো হয়ে গেল। আমার কাছে ১৫০০ টাকা হয়তো কিছুই না, কিন্তুু এই গ্রাম্য মহিলার কাছে এই মহামরীকালে এই টাকাই অনেককিছু।

গ্রাম্য মহিলাটি যে খুশি, সেটি তার চোখ-মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম। পরিশ্রমের উপযুক্ত মূল্য পেলে সবাই খুশি হয়। রাতে আরও কয়েকজন মহিলা তাদের সেলাই করা কাঁথা নিয়ে আসলো। সাধ্যমতো তিনটা কিনলাম। কেনাকাটায় যে এতো সুখ তা অনেকদিন পর আবার টের পেলাম।

নক্শী কাঁথা আমাদের গর্ব। সরকার এবং আমাদের সকলকে সচেষ্ট হতে হবে এই গ্রামীণ শিল্পকে রক্ষা করার জন্য। খেয়াল রাখতে হবে এই নক্শী কাঁথা বুননের পেছনে যে গ্রাম্য নারীর নিরলস পরিশ্রম, মেধা ও মনন জড়িত আছে, তিনি যেন উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও স্বীকৃতি পান।