করোনাভাইরাস: সরকারি নির্দেশনা-সুরক্ষা পায়নি মহল্লার ডাক্তাররা

বোরহান বিশ্বাস
Published : 14 April 2020, 08:44 PM
Updated : 14 April 2020, 08:44 PM


খিলগাঁওয়ের সাধারণ রোগীদের কাছে একজন দেবতুল্য মানুষ ডা. জিয়াউল হক।। ১০ বছর ইরানের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিয়ে ১৯৯৪ সালে দেশের টানে ছুটে আসেন। থিতু হন ঢাকার খিলগাঁও তিলপাপাড়ায়। সেই থেকে শুরু ব্যক্তিগত বা প্রাইভেট প্র্যাকটিস।

দূর-দূরান্ত থেকেও প্রতিদিন অসংখ্য রোগী আসেন তার কাছে চিকিৎসা নিতে। গরীব ও দুঃস্থ রোগীদের আর্থিক বিষয়টি তার বিবেচনায়  প্রাধান্য পায় সব সময়। ক্রীড়া সংশ্লিষ্টদের কোনো ফি ছাড়াই দেখে থাকেন সাহিত্যমনা এই ডাক্তার।

বাংলাদেশে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে তার  চেম্বারে রোগী আসছে কম। তারপরও এই দুর্যোগের সময়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

এমনিভাবেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন অনেক চিকিৎসক। যাদের ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা স্থানীয় প্রশাসন কোনোভাবেই অবগত নন।

মহামারীর এই সময়েও  ব্যক্তিগত চেম্বারে কীভাবে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন তা জানতে কথা হলো ডা. জিয়াউল হকের সঙ্গে।

চেম্বার খোলা রাখা প্রসঙ্গে এই চিকিৎসক স্পষ্ট করেই বললেন,  "অনেকদিন হলো এখানে আছি। সেই  '৯৪ সাল থেকে। দুর্দিনে যদি আমাকে ডেকে মানুষ না পায় তাহলে বিবেকের কাছে আমি কী উত্তর দেব?"

তিনি বললেন, শীত আর গ্রীষ্মের মাঝে যে আবহাওয়া পরিবর্তন হয় তার প্রভাবেই চিকেন পক্স, মাম্পস, চোখের অসুখ, সর্দি-কাশি, গলাব্যথাসহ নানা রোগ হয়। এই সময়টাতেই ভাইরাস সংক্রমতি হয় বেশি।

"আমরা যারা জেনারেল প্র্যাকটিস করি, তাদের কাছে বেশির ভাগ রোগীই আসেন সর্দি-কাশি, জ্বর নিয়ে। এটা আমাদের দেশের জন্য খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রকোপ থাকায় সর্দি-কাশি, জ্বর হলেই হাসপাতালগুলো প্রথমেই করোনাভাইরাস সন্দেহ করছে। তখন তারা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে রোগী দেখছেন, হটলাইনে যোগাযোগ করার কথা বলছেন।"

কোন ধরনের সমস্যা নিয়ে রোগীরা আসছেন?

সাধারণ সমস্যা নিয়েই বেশির ভাগ রোগী আসছেন বলে জানালেন ডা. জিয়াউল হক।

"শুধু সর্দি-জ্বর নিয়েই নয়, বয়স্ক শ্বাসকষ্টের রোগীও পাচ্ছি। কয়েকদিন আগে একজন বয়স্ক শ্বাসকষ্টের রোগী মুগদা হাসপাতাল থেকে ব্যর্থ হয়ে আমার এখানে আসেন। তার চিকিৎসা আমরা করেছি। সে এখন ভালো আছে। সেই রোগীকে আমি যেমন যত্ন নিয়ে দেখেছি, আমার সহযোগী ছেলেটিও তাকে সুন্দর করে নেব্যুলাইজার দিয়ে মাস্ক পরিয়ে দিয়েছে।"

তিনি বলেন,  "সর্দি-কাশি রোগী দেখে আমি অভ্যস্ত। এখন রোগীদের জিজ্ঞেস করি, তাদের বাসায় সম্প্রতি  বিদেশ ফেরত কেউ এসেছেন কি না? অথবা তারা এমন কোথাও গিয়েছিলেন কি না যেখানে বিদেশ ফেরত কেউ ছিল? এখন সামাজিক পর্যায়েও করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়া শুরু হয়ে গেছে। তাই অনেক বেশি সতর্ক হয়ে কাজ করতে হচ্ছে। আইইডিসিআরের দুটো নম্বর আমি টুকে রেখেছি। প্রয়োজনে সেগুলো মানুষকে দিই।"

হতাশা নিয়েই ডা. জিয়াউল হক বললেন,  "২৫ বছরে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মী, খেলোয়াড়সহ অনেকেই আমার খুব ঘনিষ্ঠ। সরকার হোক, স্থানীয় প্রশাসন হোক- যে কারো কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার অধিকার আমার আছে। তারা খোঁজ নিয়ে যদি আমাদের মতো ডাক্তারদের পিপিইসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দিয়ে সহযোগিতা করতেন তাহলে আমরা অনুপ্রাণিত হতাম। এটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অবশ্যই করা উচিত।"

মহামারী মোকাবেলার বিশাল কর্মযজ্ঞে নিজের ও নিজের মত আরো অনেক চিকিৎসকের ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দিতে সরকারের কাছে আহ্বানও জানান তিনি।

"আমার মতো শত শত এলাকার ডাক্তার যারা এখনো প্র্যাকটিসে আছেন তারা কীভাবে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী দেখবেন, প্রয়োজনে ট্রান্সফার করবেন- এ ব্যাপারে কোনো গাইডলাইন দেওয়া হয়নি। আমার অনেক ডাক্তার বন্ধুও এমন অভিযোগ করছেন।"

অভিযোগ জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন,  "স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মন্ত্রণালয় কিংবা স্থানীয় প্রশাসন কেউই আমাদের সঙ্গে নূন্যতম যোগাযোগটুকু করছেন না, কিছু বলছেন না। এ বিষয়ে আমি খুবই হতাশ। আমি নিজেই জানি না করোনাভাইরাস আক্রান্ত হলে আমার কী হবে?"

তিনি বলেন,  "সরকারি-বেসরকারি বড় কথা নয়। আমরা সবাই ডাক্তার। রোগীর চিকিৎসা করি। আমার জানা মতে, এই এলাকায় আমার চেম্বারটাই এখন শুধু খোলা। যে কারণে আশপাশের হাসপাতাল, ক্লিনিকে চিকিৎসা না পাওয়া রোগীরা আমার কাছে আসছেন। এমন বিষয় তো সরকারের উচ্চ পর্যায় না জানলেও স্থানীয় পর্যায়ে জানা থাকার কথা।

"আমরা আশা করি, তারা এসে আমাদের কাজটাকে আরো কীভাবে আপগ্রেট করা যায় সেই নির্দেশনা, পরামর্শ দেবেন।"

আর এই সেবার বিনিময়ে নিজে কোনো বীমা কিংবা ইনসেনটিভ সুবিধা চান না বলেও জানালেন জিয়াউল হক।

একজন চিকিৎসক হিসেবে ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা থেকে সেবা দিয়ে গেলেও তাদের নিরাপত্তা-সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবছেন না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

"সাসপেক্টেড রোগীদের কীভাবে গাইড করবো, আইইডিসিআর কিংবা কুর্মিটোলা পর্যন্ত পৌঁছে দেব কীভাবে সেই বার্তা নিয়ে এখনো পর্যন্ত কেউ আসেনি, কোনো দিক-নির্দেশনাও পাইনি। করোনাভাইরাস বিষয়ে রোগীদের অনেক প্রশ্ন থাকে আমাদের কাছে। কিছু বলি, কিছু বলি না। কারণ আমার কোনো গাইডলাইন নেই",  বলেন ডা. জিয়াউল।

নিজের ব্যক্তিগত সুরক্ষার প্রসঙ্গে তিনি বলেন,  দুটি ওষুধ কোম্পানি থেকে পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট ( পিপিই) পেয়েছেন।

"কিছুদিন শুধু মাস্ক পরে রোগী দেখেছি। একদিন আমার এক পরিচিত এসে অবস্থা দেখে একটি পিপিই দিয়ে গেছে।"

প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা ডাক্তারদের একজন হয়ে আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বললেন,  "এই সময়ে আমাদের শুধু একটিই চাওয়া, করোনাভাইরাস রোগীদের কীভাবে গাইড করবো এবং আক্রান্তদের কীভাবে যথাস্থানে পৌঁছে দেব সে বিষয়ে সঠিক দিক-নির্দেশনা পাওয়া।"

গত ৮ মার্চ নভেল করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত আক্রান্তদের বেশিরভাগই রাজধানীর বাসিন্দা। এই সময় জীবন বাঁচাতে সাধারণ মানুষদের মতো কোনো কোনো চিকিৎসকও স্বেচ্ছায় ঘরবন্দি হয়ে আছেন। আবার ভয়াবহ এই পরিস্থিতির মধ্যেও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কেউ কেউ দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এখনো চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

এরমধ্যে  রাজধানীসহ দেশে বিভিন্ন জেলায় স্বাস্থ্যকর্মী-চিকিৎসকরা আক্রান্ত হয়েছেন। কিছু কিছু হাসপাতালও অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার মত ব্যক্তিদের অভাব তৈরি হতে পারে সামনে।

এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যেতে ডা. জিয়াউল হকের মত স্থানীয় পর্যায়ের চিকিৎসকদেরও সরকারের করোনাভাইরাস মোকাবিলার পরিকল্পনার আওতায় অতি দ্রুত আনা উচিৎ।