হিথরো থেকে ভারত হয়ে ঢাকায় জনতার মাঝে ফিরলেন বঙ্গবন্ধু

মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার
Published : 8 Jan 2020, 11:30 AM
Updated : 8 Jan 2020, 11:30 AM

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা পরাজিত হলেও পূর্ণ বিজয়ের আনন্দ তখনো দেশবাসী উদযাপন করতে পারেনি। কারণ তখন পর্যন্ত আমাদের জানা ছিল না বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন না বেঁচে নেই। উনি ফিরে আসবেন কি ফিরে আসবেন না। সবকিছুই ছিল অনিশ্চয়তার মধ্যে। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে শত্রুবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও বঙ্গবন্ধুর পরিবারবর্গ মুক্ত হয়েছিলেন পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর ধানমন্ডির সেই বাসা থেকে।

বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানে আটক তখন একটি মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে প্রচার করতে থাকে যে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে আন্তরিক নন। এই সংবাদ শুনে পরদিন সকালে বঙ্গভবনে গিয়ে তাজউদ্দিন আহমেদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া এবং তাকে জানান এই উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার কথা। তখন বঙ্গবন্ধুর পরিবার ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর রোডের বাসায় থাকতেন। সেদিন বিকালে তাজউদ্দিন আহমেদ সেখানে যান এবং বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে সকল বিষয় অবহিত করেন; সেইদিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এর পরদিন ঐ বাসায় একটা টেলিফোন সংযোগ স্থাপন করা হয়েছিল।

সেই সময়ে বিশ্বের প্রায় সব জায়গা থেকেই বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। জাতিসংঘের মহাসচিব, ইউরোপের প্রায় অর্ধেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, এমনকি আন্তর্জাতিক আইনজীবী সমিতিও ইসলামাবাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আবেদন জানান। অনেকগুলো মুসলিম দেশের সঙ্গে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের কাছে অনুরোধ জানায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এও বলা হয়েছিল যে শেখ মুজিবের যদি কিছু হলে তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব পাকিস্তানকে গ্রহণ করতে হবে এবং তার ফলাফল কখনোই ভালো হবে না।

অবশেষে ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি করাচির এক জনসভায় জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। ৮ জানুয়ারি বিবিসির সকালের সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে ৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে একটি বিমানে করে লন্ডনের পথে পাঠিয়ে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারবর্গ তখনো দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারেননি।

বিবিসির পরবর্তী সংবাদে বলা হয় যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উক্ত বিমানটি ওইদিন সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। লন্ডন বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ অফিসের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন এবং লন্ডনের হোটেল ক্লারিজে তার জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এই খবর প্রচার হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের ও চার বোন ও তাদের পরিবারবর্গ ও ঢাকায় অবস্থানরত অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন ১৮ নম্বর রোডের বাসায় ছুটে গিয়েছিলেন। তখন সকলের দু'চোখ ভরে উঠেছিল আনন্দাশ্রুতে। ওইদিনই সন্ধ্যা সাতটার দিকে টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল, প্রথমে কথা বলেছিলেন বেগম মুজিব, এরপর অন্যরা। ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু দেখা করেন।

সেই সময় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী সফরে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যাওয়ার খবরে উনি সফর সংক্ষিপ্ত করে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধুর গাড়িটা ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে পৌঁছালে এডওয়ার্ড হিথ নিজে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলেন যতক্ষণ না বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে বের হয়েছেন।

৯ জানুয়ারি সকালে বেগম মুজিব ড. ওয়াজেদকে বলেন, তিনি যেন তাজউদ্দিন আহমেদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করে বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার সময়সূচি জেনে আসেন। সেদিন সকাল ১০টার দিকে সুলতান শরীফকে সঙ্গে নিয়ে ড. ওয়াজেদ বঙ্গভবনে তাজউদ্দিন আহমেদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন। তাজউদ্দিন সাহেব বলেন যে তিনি দুপুরের দিকে ধানমন্ডির বাসায় যেয়ে বেগম মুজিবের সঙ্গে আলাপ করে বঙ্গবন্ধুর ফেরার সময় সূচি চূড়ান্ত করবেন।

ঐদিন তাজউদ্দিন আহমেদ সাহেব বেগম মুজিবের সাথে পরামর্শ করার জন্য বেলা একটার দিকে ধানমণ্ডির বাসায় এসেছিলেন। তাজউদ্দিন সাহেব বেগম মুজিবকে জানান, ইতোপূর্বে লন্ডন ও দিল্লির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার ব্যাপারে একটা সময়সূচি তৈরি করেছেন। ওই সময়সূচি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু একটা বিশেষ ব্রিটিশ বিমানে ৯ জানুয়ারি রাতে লন্ডন ত্যাগ করবেন এবং পরদিন দুপুরের দিকে দিল্লি পৌঁছাবেন।

দিল্লিতে ঘন্টাখানেকের জন্য ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে কলকাতা পৌঁছে সেখানে এক ঘণ্টা যাত্রা বিরতি করে বিকাল ৪টার দিকে ঢাকা পৌঁছবেন। ঢাকায় পৌঁছানোর পর রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় ভাষণ দেবেন। ঐদিন কলকাতাতেও যাত্রা বিরতি করলে ঢাকার রেসকোর্স সভাস্থলে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে এই ভেবে বেগম মুজিব তাজউদ্দিন সাহেবকে কলকাতার কর্মসূচি বাতিল করার পরামর্শ দেন।

দিল্লিতে বিমান পরিবর্তন করলে ব্রিটেনের জনগণ মনক্ষুন্ন হতে পারে সেই কারণে ঐ ব্রিটিশ বিমানেই বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে আসার নির্দেশনা দেন বেগম মুজিব। এই নির্দেশনার পর তাজউদ্দিন সাহেব দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ডি পি ধরকে টেলিফোন করে তাকে অবহিত করেন। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে লন্ডন থেকে ঢাকা ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে এক ঘণ্টার জন্য যাত্রা বিরতি করে একই বিমানে দিল্লি থেকে সোজা ঢাকা নামবেন।

বেগম মুজিব প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিতা ছিলেন না কিন্তু উনার প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক বিবেচনা বোধ, সামাজিক বিবেচনাবোধ ছিল খুবই উচ্চমার্গের। সেইজন্যই সেইসময়ে উনি এত সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত দিতে পেরেছিলেন। যতদূর জানি দিল্লিতে ব্রিটেনের ওই বিমানের যাত্রীদের তল্পিতল্পা ভারতীয় একটা বিমানে ওঠানো হয়েছিল। তারপর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এবং ঢাকার নির্দেশনার কারণে সেগুলোকে আবার ব্রিটিশ বিমানে তোলা হয় এবং বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ সেই বিমানেই ঢাকা অবতরণ করেন।

পাকিস্তান থেকে বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে বিমানে তুলে দেওয়া হয়েছিল ৮ জানুয়ারি। সেটাকে একটা স্ট্রাটেজিক কার্গো হিসেবে ননস্টপ লন্ডন পাঠানো হয়েছিল। সেই সময় পর্যন্ত কেউ জানত না যে বঙ্গবন্ধু ওই বিমানে আছেন। বিমান লন্ডন পৌঁছার আধা ঘণ্টা আগে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ওই বিমানে আছেন।

লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে নেমেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন সেখানকার কর্মকর্তারা সবকিছু অবগত। নামার পরপরই বঙ্গবন্ধুর ফোন এলো। ইয়ান সাদারল্যান্ড ব্রিটিশ ফরেন অফিস থেকে বঙ্গবন্ধুর খোঁজ নিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুকে ফোনে তিনি বললেন, আধঘণ্টা আগেই আমরা জেনেছি। আপনাকে আমরা এখানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেবো। ব্রিটিশ সরকারের সবরকম রাষ্ট্রীয় প্রটোকল থাকবে আপনার জন্য।

বঙ্গবন্ধুকে রাখা হয়েছিল লন্ডনের রাসেল স্কয়ারের ক্লারিজ হোটেলে। সেখানেই সাধারণত রাষ্ট্রীয় অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা করে ইংল্যান্ড সরকার। এই হোটেলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও থেকেছেন ব্রিটেন সফরে গিয়ে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই হোটেলে থাকতে রাজি ছিলেন না উনি বলেছিলেন রাসেল স্কয়ারের কোন ছোটখাটো হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করার জন্য। কারণ বাঙালিরা আসবে উনার সাথে দেখা করতে বড় হোটেলের নিরাপত্তার কারণে সমস্যা হবে। কিন্তু ইংল্যান্ড কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হয়নি। কারণ বঙ্গবন্ধু তখন শুধু জননেতা নন একজন রাষ্ট্রপতিও।

ক্লারিজ হোটেলের সামনে বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য কয়েক হাজার মানুষের ভিড় জমে গিয়েছিল। তখন হোটেল কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করে উপর থেকে জানালা দিয়ে তাদেরকে একটু দেখা দেবার জন্য।

পরে হোটেল লবিতে জনাকীর্ণ এই সংবাদ সম্মেলনে ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, "একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের জন্য আমাদের লড়াইয়ের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। পাকিস্তানের কারাগারের কনডেম সেলে আমি যখন ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন বাংলাদেশের জনগণ আমাকে তাদের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাধীনতাকামী সব রাষ্ট্র যারা আমাদের সমর্থন দিয়েছে তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিশেষত ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপিয়ান রাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্বাধীনতাকামী জনগণ যারা আমাদের সমর্থন জানিয়েছেন তাদের সকলকে আমি ধন্যবাদ জানাই। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগোষ্ঠীকেও তাদের সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। এখন আমি সকল রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাই বাংলাদেশকে অতিসত্বর স্বীকৃতি দিতে এবং জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তিতে সমর্থন জানাতে।"

বঙ্গবন্ধু বলেন, "বিশ্বের আর কোনো দেশের মানুষকে বাংলাদেশিদের মতো স্বাধীনতার জন্য এতটা মূল্য দিতে হয়নি। আমিও একটি মুহূর্তের জন্য তাদের এই দুর্দশার কথা ভুলতে পারিনি। তাই আমি দেশ ও দেশের বাইরে থাকা প্রত্যেক বাংলাদেশিকে ধন্যবাদ জানাই। অভিনন্দন জানাই মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে। যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করা লাখ লাখ মানুষের শোকাহত পরিবারের প্রতি জানাচ্ছি সমবেদনা ও বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।"

এক ব্রিটিশ সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, "বাংলাদেশে কী বীভৎসতা চালানো হয়েছে তা শুনলে আপনারা আশ্চর্য হবেন। লাখ লাখ মানুষকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, মাইলের পর মাইল যেভাবে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, বেঁচে থাকলে হিটলারও হয়তো লজ্জা পেতেন।"

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আমি ৩৫ বছর ধরে রাজনীতি করছি, আমি জানতাম, আমি যদি কারাগারেও যাই বা বেঁচে নাও থাকি বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনবেই। "

বঙ্গবন্ধু বলেন, "আমাকে যে কারাগারের যে সেলে রাখা হয়েছিল সেখানে সূর্যের আলো বা বাতাস কিছুই ঢুকত না, কোন রেডিও বা খবরের কাগজও দেওয়া হতো না। বিশ্বের কোনো কিছুর সঙ্গেই আমার যোগাযোগ ছিল না। অবশ্য জুলফিকার আলী ভুট্টো আমার কাছে এসেছিল। তার মাধ্যমেই প্রথম জানতে পারি বাংলাদেশের সরকার গঠনের কথা, আমাকে প্রেসিডেন্ট করার কথা।"

সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, "আমি সহায়তার জন্য সারা বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানাই। কারণ সুজলা-সুফলা বাংলাদেশে শুধু লাখ লাখ মানুষই মারা যায়নি, হাজার হাজার কিলোমিটার রাস্তা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, রেলপথ ধ্বংস করা হয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, অর্থনীতিকে পুরো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আমি আবেদন জানাই দরিদ্র মানুষকে বাঁচানোর জন্য।"

প্রশ্নকারী ব্রিটিশ সাংবাদিককে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশ যে কতটা সম্পদশালী ছিল তা আপনারা জানেন। কিন্তু একশ-দেড়শ বছরের বিদেশি শাসনে থেকে অনেক কিছুই হারিয়েছে বাংলাদেশ। আমি মনে করি ব্রিটিশ সরকারেরও এখন দায়িত্ব বাংলাদেশকে সহায়তা করা। কারণ বাংলাদেশের সম্পদ আহরণ করেই আজকের ব্রিটেনে অনেক স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। সেই ঋণ আজ পরিশোধের সময় এসেছে। শুধু ব্রিটেন নয়, আমি সারা বিশ্বের প্রতি লাখ লাখ মানুষকে ক্ষুধার জ্বালা থেকে বাঁচানোর আহ্বান জানাই।"

বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক শিষ্টাচার ছিল প্রখর কিন্তু এইদিন তিনি তার তোয়াক্কা করেননি। উপরে যে কথাগুলো তিনি ব্রিটিশ সাংবাদিককে বলেছেন সাধারণত একজন রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রীয় অতিথি এই ভাষায় বলে না। সেদিন তিনি রাষ্ট্রপতির আচরণ না করে একজন সাহসী জননেতার মত আচরণ করেছিলেন কারণ তাঁর জনগণ তখন চরম দুর্দশায় ছিল। ব্রিটেনের মাটিতে বসে তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তোমারাও একদিন আমাদের লুটেছে।"

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি? তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, আপনি আমার জন্য একটা বিমানের ব্যবস্থা করতে পারেন আমি দ্রুত আমার জনগণের কাছে ফিরতে চাই। আর বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে পারেন।

তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তার সচিবকে ডেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন। আর বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে জানান, এটা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুকে তো তারা রাষ্ট্রপতি হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার যে সমস্ত প্রটোকল পাওয়া দরকার সবকিছু তিনি পাচ্ছেন। অতএব এ নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। এর কয়েকদিন পরেই যুক্তরাজ্য প্রথম ইউরোপিয়ান দেশ হিসাবে ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

৮ জানুয়ারি হিথ্রো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বসেই বঙ্গবন্ধু ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। এরই ফাঁকে বঙ্গবন্ধু খোঁজ নিয়েছিলেন লন্ডন হাইকমিশনে থাকা আবু সাঈদ চৌধুরীর। তখন সাদারল্যান্ড জানিয়েছিলেন, আবু সাঈদ চৌধুরী ইতোমধ্যে ঢাকার উদ্দেশে লন্ডন ছেড়েছেন। এরপরে যিনি দায়িত্বে আছেন তার ফোন নম্বর দিতে বলেন। তখন ডেপুটি হিসেবে কাজ করছিলেন রেজাউল করিম। খোঁজ নিতেই তার ফোন চলে এলো। ফোনে রেজাউল করিম কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। জানালেন, আধঘণ্টার মধ্যেই তিনি বিমানবন্দরে পৌঁছবেন।

সে সময় লন্ডনে পাকিস্তানের হাইকমিশনার ছিলেন নাসিম আহমদ। তিনি বিমানবন্দরে ঢুকে বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ক্যান উই ডু অ্যানিথিং ফর ইউ, স্যার?

বঙ্গবন্ধু বললেন, ইউ হ্যাভ ডান এনাফ। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।

বিমানবন্দর থেকে হোটেলে যেতে এক ঘণ্টার মতো সময় লেগেছিল। বঙ্গবন্ধু ডেপুটি রেজাউল করিমকে গাড়িতে তুলে নিয়েছিলেন। গাড়িতে বসেই তার কাছ থেকে নয় মাসের ঘটনাপঞ্জি জানতে চাইলেন কী কী হয়েছে এ সময়ের মধ্যে। হোটেলে পৌঁছানোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বেগম আবু সাঈদ চৌধুরী, ব্রিটিশ ডেপুটি লিডার পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হ্যারল উইলসন ও খ্যাতনামা সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন।

৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর জন্য রাখা দুটো বিমান খালি ছিল। যার একটি প্রধানমন্ত্রীর অন্যটি অতিরিক্ত থাকে। সেখান থেকে একটা বিমানে বঙ্গবন্ধুকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। পরদিন ৯ জানুয়ারি লন্ডন সময় সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে ঢাকায় ফেরার জন্য বঙ্গবন্ধু ওঠেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবহরের কমেট জেটে। সেদিন বিমানে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ গ্রেট ইস্টার্ন ইন্স্যুরন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মওলা, ড. কামাল হোসেন, ভারতীয় একজন কূটনীতিকসহ অনেকেই।

বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান ৮টা ৩০ মিনিটে স্থানীয় সময় লন্ডন থেকে যাত্রা করেছিল। এর অর্থ বাংলাদেশ সময় ২টা ৩০ মিনিটে উড়েছিল বিমানটা। যতদূর জানি সেই সময় পর্যন্ত ইউরোপে গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন সময়ের প্রচলন হয়নি। সেক্ষেত্রে তখন শীতকাল ছিল বিধায় সময়ের পার্থক্য এখনকার মতই হবার কথা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীর কমেট জেট বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করেছিল ১১ জানুয়ারি বেলা ১টা ৪১ মিনিটে। এই সময় পূর্বদেশের খবর অনুযায়ী। অবশ্য ওয়াশিংটন পোস্ট একই দিনে লিখেছে, ১টা ৪৫ মিনিটে (সকাল ০২টা ৪৫ মিনিট ইএসটি) অবতরণ করে।

লন্ডন থেকে রওনা হওয়ার ২৩ ঘণ্টা ১১মিনিট পর বঙ্গবন্ধু ঢাকাতে পৌঁছেছিলেন। মাঝে দিল্লিতে ২ ঘণ্টা যাত্রা বিরতি। তাহলে বাকি ২১ ঘণ্টা ১১ মিনিট কি উড়েছিল বিমানটা? যে সব দেশের উপর দিয়ে বিমানটা উড়েছিল তাতে সর্বমোট আকাশ পথে ৫৭২৮.১৭ মাইল (৯২১৮.৮৩ কিলোমিটার) যা স্থল পথে ৯২৮২.৮৫ মাইল (১৪.৯৩৯.৮৩ কিলোমিটার)। বর্তমান যুগের হিসাব অনুযায়ী বিমানটা উড়েছিল ১৬ ঘণ্টা।

লন্ডন থেকে বিমানটা বিরতিহীন দিল্লী পর্যন্ত উড়েনি পথে জ্বালানির জন্য সাইপ্রাস এবং শারজায় নেমেছিল। সাইপ্রাসের রাজধানী নিকোসিয়ার যে বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতী করেছিল বিমানটা সে বিমানবন্দরটা এখন আর নেই। তুর্কির আগ্রাসনের পর সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। আর দিল্লিতে যাত্রা বিরতির সিদ্ধান্ত হয়েছিল আগেই। ইতোমধ্যে কলকাতা থেকে প্রচুর টেলিফোন পাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আপনি দিল্লি যাবেন কিন্তু কেন কলকাতা নয়? বঙ্গবন্ধুও খানিকটা দ্বিধায় পড়েছিলেন। কারণ যুদ্ধ চলাকালে সবচেয়ে বেশি অবদান আর সাহায্য করেছে এই পশ্চিমবঙ্গ। বিমান কর্তৃপক্ষ জানালো, তা সম্ভব নয়। দিল্লি থেকেই ঢাকায় ফিরতে হবে। সে অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু সবাইকে জানিয়ে দিতে বলেন, তিনি দেশে ফিরে দ্রুতই কলকাতা সফর করবেন।

সেদিন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিমানটা চালিয়েছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার মিস্টার কুক। ঢাকা যাবার আগে তিনি বিস্তারিত জেনে নিয়েছিলেন ঢাকা এয়ারপোর্ট সম্বন্ধে। কতটা লম্বা রানওয়ে, সেখানে অবতরণ করতে পারবে কিনা। সবকিছু ঠিকঠাক হলেই তিনি উড়েছিলেন। সম্ভবত এসব কারণেও দিল্লি থেকে ভারতীয় একটা বিমান প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। যদি কমেট জেট সেখানে অবতরণ করতে না পারে সেক্ষেত্রে বিকল্প ভারতীয় বিমান।

দিল্লিতে দুই ঘণ্টার যাত্রা বিরতির সময় অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণ হয়। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। এর আগে বা পরে ভারতীয় রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকারপ্রধান উভয়ে একত্রে উপস্থিত থেকে বিমানবন্দরে কোনো অতিথিকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন তা আমার জানা নেই। বিশ্বের ইতিহাসেও এ জাতীয় ঘটনা বিরল। শুধু তাই না বিমানবন্দরে ইন্দিরা গান্ধী তার পুরো ক্যাবিনেট নিয়ে উপস্থিত ছিলেন সেই শীতের সকালে।

বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে নামার পর এক আবেগঘন দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। সেদিন যেন একটা পরিবারের মিলন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর একজন সফর সঙ্গী বলেছেন, "যেদিকে তাকাই সবার চোখে জল।" চিফ অব প্রটোকল অফিসার ছিলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির ক্যাপ্টেন মাহবুব আহমেদ খান। সব দেখে তিনি ড. কামালকে বলেছিলেন, "এখানে প্রটোকল অফিসারের কোনো ভূমিকা আছে কি?" তারপর তিনি বলেছিলেন, পাশের মাঠেই হাজার হাজার লোক সমবেত হয়েছে। আপনার লিডারকে যদি একটু বলেন, তিনি যেন মঞ্চে সমবেত হয়ে কিছু বলেন। ইন্দিরা গান্ধীও সঙ্গে থাকবেন। দ্বিতীয় হচ্ছে, আমরা ওনাকে রাষ্ট্রপতি ভবনে নিয়ে যাবো। এককাপ চা খেয়ে উনি ঢাকায় রওনা হবেন। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠে ইংরেজিতে বলতে শুরু করলে তাকে জনতার পক্ষ থেকে বাংলায় বলতে অনুরোধ করা হয়। তখন ইন্দিরা গান্ধীও বঙ্গবন্ধুকে বাংলায় বলতে বলেন।

ঢাকায় ফেরার পরের গণসংবর্ধনার কথা আজ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত যেতে দুই ঘণ্টার উপরে সময় লেগেছিল সেদিন বঙ্গবন্ধুর। রাস্তায় ছিল জনতার ঢল।