আজও কেন চেতনার বিভাজন, প্রশ্ন শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তানদের

স্বাধীন বাংলাদেশ একদিন হবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পমুক্ত, থাকবে অর্থনৈতিক সাম্য আর সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, বাঙালি জাতীয়তাবাদই হবে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আদর্শ- এই চেতনার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেননি তারা; জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সেই চেতনার পথে ৫০ বছরে কতটা এগোল বাংলাদেশ?

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2021, 06:29 PM
Updated : 26 March 2021, 01:52 PM

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানেরা বললেন, জাতির পিতার আদর্শে সোনার বাংলা গড়ার পথে এ দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় তারা গর্বিত।

কিন্তু এই এতদিন পরও সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন তাদের শঙ্কিত করে, সমাজের বিভাজন তাদের বলে দেয়- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চেতনার লড়াই আজও শেষ হয়নি।

চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হানের খোঁজ মেলেনি ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির পর। বড় ভাই আরেক শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের খোঁজে ঢাকার মিরপুরে গিয়ে আর ফেরা হয়নি তার।

জহির রায়হানের ছেলে নাট্যনির্মাতা অনল রায়হান মনে করেন, ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে অর্থনৈতিক উন্নতি এলেও দেশ এখনো ‘সাম্প্রদায়িক শক্তির’ রাহু থেকে মুক্ত নয়।

“সবচাইতে যন্ত্রণাদায়ক হচ্ছে, যে আদর্শ সামনে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ৫০ বছর আগে, সেটার বাস্তবায়ন কি আমরা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পেরেছি?”

শহীদ চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের ছেলে নাট্যনির্মাতা অনল রায়হান

অনল রায়হান বলেন, বাংলাদেশের পিছিয়ে যাওয়ার শুরু পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর; যখন দেশ সামরিক শাসন ও সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে গেল।

“সামরিক দুঃশাসনের ওই সময়টাতে গোটা একটা প্রজন্মের মননে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে দেওয়া হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এরাই বিভিন্ন চাকরিতে ঢুকেছেন। ফলে শেখ হাসিনা সরকার যখন ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এল, তখন খুব সহজ ছিল না দীর্ঘদিনের সাম্প্রদায়িক-সামরিক সংস্কৃতিকে বদলানো।”

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সন্তুষ্টি জানিয়ে বাংলাদেশকে জাতিগত ও ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে দেখার আকাঙ্ক্ষার কথা জানালেন অনল রায়হান। বললেন, “অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে না ওঠায় প্রগতিশীল এবং বাঙালি জাতিসত্ত্বা নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারা এখনও ভীত-সন্ত্রস্ত।”

তিনি জানান, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার ‘সাইকোলোজিক্যাল ট্রমা’ এখনো মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোকে তাড়া করে।

“কিছু হলেই একটা ভয় ঢুকে যায়। কোথাও গোলাগুলি হল বা উর্দু কথা শোনা গেল, মনে হয় এটা একাত্তরের সময়টা। এখনই বোধ হয় পাকবাহিনীর একটা ট্রাক আসবে, ‘নারায়ে তাকবির’ বলে জামায়াতের কোনো লোক ছুটে আসবে। এই ট্রমাটা মুক্তিযুদ্ধের পরিবারের বেশিরভাগ সন্তানদের মধ্যে আছে।”

অনল রায়হান বলেন, পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন দেশকে যেমন লক্ষ্যভ্রষ্ট করেছে, তেমনি খুবই দুর্বিষহ সময়ে ফেলেছিল শহীদ পরিবারগুলোকে।

তিনি বলেন, “আমার মা চলচ্চিত্রে ছিলেন বলে প্রথমদিকে তার কিছুটা অর্থনৈতিক সঙ্গতি ছিল। কিন্তু আশি-নব্বইয়ের দশকে আমাদের ভয়াবহ আর্থিক কষ্ট গেছে।”

“১৯৮৫ সালে মোহাম্মদপুরে হুমায়ূন রোডের বাসা থেকে এরশাদ আমাদের পরিবারকে উচ্ছেদ করলেন এবং বলে দিলেন, জহির রায়হান যেহেতু ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি নিহত হয়েছে, সেহেতু তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ না।”

“আমাদের মায়েদের প্রচণ্ড কষ্ট গেছে। আর একদম সাধারণ পরিবার যেমন কৃষক বা শিক্ষকের পরিবার- এরা কিন্তু একেবারে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল।”

জহির রায়হানের পরিবারের মতই আরেক শহীদ বুদ্ধিজীবী সুরকার আলতাফ মাহমুদের পরিবারকেও বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বাড়ি থেকে ১৯৮২ সালে বিনা নোটিসে উচ্ছেদ করা হয়।

শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ

তার মেয়ে শাওন মাহমুদ বলেন, “পঁচাত্তরের পরে দৃশ্যপট অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। আমার মত অনেক শহীদ পরিবারের সন্তান স্বাধীন দেশে উচ্ছেদ হয়েছে।

“আমি সেদিন কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসেছিলাম, রাতে কোথায় থাকব জানতাম না। মা তার এক বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আরেক বাসায় উঠেছিলেন। বাবা না থাকায় পুরো ভারটাই ছিলো মায়ের ওপরে।”

শহীদ পরিবারের সন্তানদের অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “শুধু দেশকে ভালবাসতে গিয়ে আমাদের বাবা চলে গিয়েছেন। সেজন্য স্বাধীন দেশে আমরা মাথা উঁচু করে থাকি; হয়ত অনেক অপমানের কথাই জানাই না।”

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চললেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি না হওয়ার হতাশা রয়েছে শাওনের।

“মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর হয়ে গেছে। তৃণমূলের যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের অনেকেই কিন্তু বেঁচে নেই। তথ্যগুলো সময় থাকতে বের করার জন্য সব সময় আমরা বলে এসেছি। কোনো অজানা কারণে হয়ত করা হয়নি।”

মুক্তিযুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতার এবং ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে একসঙ্গে চলার যে চেতনা ছিল; বর্তমান বাংলাদেশে সেই জায়গাটায় ‘ঘাটতি’ দেখতে পান শাওন মাহমুদ।

সুরকার আলতাফ মাহমুদকে ১৯৭১ সালের ৩০ অগাস্ট বন্দি করে পাকিস্তানি বাহিনী। এরপর আর তার খোঁজ মেলেনি।

শাওন মাহমুদ বলেন, তার বাবা সংগীত পরিচালক হলেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর থেকে ঘরে পেট্রোল জমিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।

“পরে মা জানতে পেরেছিল, বাবা বোমা তৈরির জন্য ওটা জমাচ্ছিল। বাবা ক্র্যাক প্ল্যাটুনের সাথে জড়িয়ে গেল। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া থেকে শুরু করে তাদের অস্ত্র আনা-নেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের পার করা, বিভিন্ন তথ্য বের করা- একেবারেই জড়িয়ে গিয়েছিল ক্র্যাক প্লাটুনের সাথে।

“শেষ পর্যন্ত দুই ট্রাঙ্ক অস্ত্র এনে বাবা বাসায় রেখেছিল। সেখান থেকে উনি ধরা পড়লেন। বাবা জানতেন, উনি কী করছেন এবং উনার সাথে কী হতে পারে।”

১৯৮৬ সাল পর্যন্ত শাওন মাহমুদ অপেক্ষা করতেন, তার বাবা ফিরে আসবেন।

“আস্তে আস্তে বড় হবার পর বাবার ওপর অত্যাচারের কথা জেনেছি। বাবাসহ আরও সাতজন গেরিলা নিখোঁজ। তাদের মৃত্যুদিন জানা নেই, কবরও নেই। এটুকু জানতে পেরেছি, ওরকম অত্যাচারের পর তাদের বেঁচে থাকার কথা না।”

বাবার মরদেহের খোঁজে গবেষণা হবে, এখন সে অপেক্ষা শাওন মাহমুদের।

“যে পরিবার থেকে কেউ নিখোঁজ হয়, তারা কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপেক্ষাই করে। স্বজনেরা শেষ পর্যন্ত মৃতদেহটা অন্তত দেখতে চায়। স্বাধীনতার পরে পচে গলে যাওয়া বদ্ধভূমিগুলোতে আমার মা ছুটে গেছেন শুধু মেনে নেওয়ার জন্য যে, উনি আর ফিরবে না।

“হয়ত বয়স হয়েছে দেখে আমি মেনে নিয়েছি, কিন্তু বাবার জন্য সেই অপেক্ষা এখনও রয়ে গেছে।”

শাওন জানান, ১৯৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার নাখালপাড়ার এমপি হোস্টেলে তার বাবার প্রবেশের নথি আছে। কিন্তু বের হয়ে আসার কোনো তথ্য নেই।

“তারা তো উধাও হয়ে যেতে পারেন না। কোন গবেষণা হয়নি বা কেউ খুঁজতে যায়নি যে, ওখানে মাটির নিচে কারও মৃতদেহ আছে কিনা বা তারা কোথায় গেল।”

শাওন মাহমুদ বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারগুলো যারা স্বজন হারিয়েছে, প্রাপ্তি নিয়ে আমরা কখনও ভাবি না। আমরা সব সময় ভেবেছি, যে আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ পাওয়া, যে কারণে যুদ্ধ হয়েছে, সেই বাংলাদেশটা যেন আমাদের থাকে। সেই বাংলাদেশটা যেন আমরা পাই।”

শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূরের ভাষায়, স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে সমাজ গড়ার স্বপ্নে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য প্রথম ধাক্কাটি ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, এরপরই পাল্টে যেতে থাকে দেশের ইতিহাস ও গতিপথ।

“শেখ মুজিবুর রহমান নামের মানুষটি সম্পর্কে কোনো কথা বলা যেত না। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়।

শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূর

“নতুন প্রজন্মের স্মৃতি থেকে একাত্তরের আদর্শ মুছে ফেলার প্রচেষ্টা শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র নষ্ট করা হয়েছে। বিতর্কিত তথ্য দেওয়া হয়েছে পাঠ্য বইয়ে। জিয়া-এরশাদের আমলে একজন মুক্তিযোদ্ধা তার পরিচয় দিতে পারতেন না। পরিচয় দিতে গেলে হয়রানির শিকার হতেন।”

দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেনকে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনা ও আল বদর বাহিনী বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আর তার খোঁজ মেলেনি।

নিউ ইয়র্কের বিংহ্যামটন ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং স্কলার তৌহিদ জানান, তার বাবার হারিয়ে যাওয়ার সময় তার ব্যাংকে ছিল মাত্র ৬৫ টাকা। আট সন্তানকে নিয়ে ৩২ বছর বয়সে মা তখন পড়েন বিপাকে। ১৯ নম্বর নিউ ইস্কাটনে অন্যান্য শহীদ পরিবারের সাথে বঙ্গবন্ধু তাদেরও থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

“বাসা থেকে উচ্ছেদের নোটিশ জিয়ার আমল থেকেই আমরা পেতে শুরু করি। এরশাদের আমলে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে আমাদের উচ্ছেদ করা হল। এই দেশের জন্য আমার বাবা শহীদ হয়েছেন, বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে সম্মানের সঙ্গে এখানে থাকতে দিয়েছেন, অথচ এই বাসা থেকে চরম অপমান করে আমাদের উচ্ছেদ করা হল।”

“শুধু আমাদের পরিবার নয়, অনেক শহীদ পরিবারের সাথেই এটা হয়েছে। একাত্তরের শহীদ পরিবারকে মুক্তিযুদ্ধের পর নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমাদের এমনও সময় গেছে, ঈদ এলে আমরা পিঠাপিঠি ভাইয়েরা একই কাপড় বদলে পড়তাম।”

তৌহিদ বলেন, জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এদেশের প্রশাসন ও রাজনীতিতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে পুনর্বাসন করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশ গড়ার পথ কঠিন করে ফেলেন।

“যখন আমরা ৫০ বছরের এ লগ্নে প্রত্যাশা পূরণের কথা ভাবি, তখন আমি বলব এত চড়াই-উৎরাই, এত বিরুদ্ধ স্রোত আমাদের এ সমাজের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে গেছে, যে কারণে প্রত্যাশার জায়গাটি নানাভাবে বিঘ্নিত হয়েছে।

“কষ্টের জায়গাটি হল, আমরা যখন বড় হয়ে উঠছি ধীরে ধীরে আমাদের চেতনাগত জায়গায় পার্থক্য তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এরপরও তরুণ প্রজন্মের সচেতনতা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকার কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে”, বলেন তৌহিদ রেজা নূর।

“আমাদের সমাজ এখনও অনেক দ্বিধা বিভক্ত। তার মধ্য দিয়েও মুক্তিযুদ্ধের মূল ধারা বের হয়ে এসেছে। সে কারণে এখন আমাদের লড়াই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চেতনার লড়াই। এটা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উপলব্ধি আসা দরকার যে, তারা কোন চেতনায় থাকবে।”

সাম্প্রদায়িকতার থাবা রুখতে জনগণের মানসিকতার পরিবর্তন এবং রাষ্ট্রের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান শহীদ বুদ্ধিজীবীর এই সন্তান।