'সাকার বাড়ির গ্যারেজ ছিল নির্যাতন কেন্দ্র'

চট্টগ্রামের গণি বেকারি মোড়ে সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর গুডস হিলের বাসভবনের গ্যারেজটি একাত্তরে ব্যবহৃত হতো নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে। আর গ্যারেজের দোতালায় ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের ক্যাম্প।

মিন্টু চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2011, 09:08 AM
Updated : 30 Sept 2013, 01:48 PM

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এই তথ্য।

মঙ্গলবার বিকেলে গুডস হিলের বাড়িটি পরিদর্শন শেষে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, "সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্ত করার জন্যই এখানে এসেছি আমরা।"

তিনি জানান, ওই সময় মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে এই বাড়িতে ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। এর মধ্যে কাউকে হত্যা করা হতো, আবার কাউকে কাউকে দালালদের সুপারিশে ছেড়ে দেওয়া হতো। তদন্তে এর সাক্ষ্য-প্রমাণ মিলেছে।

"এ কারণেই আমরা গুডস হিলের এই গ্যারেজ পরিদর্শন করেছি। তদন্তে আরও যাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের বিষয়েও খতিয়ে দেখছি।"

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিএনপি নেতা, সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল গত শুক্রবার চট্টগ্রামে এসে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে প্রত্যক্ষদর্শী ও নির্যাতিতদের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করেন। বিশেষ করে রাউজান এলাকায় সাকা চৌধুরী ও তার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং তাদের অনুগতদের নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করেন তারা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতনের শিকার সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী ম. ছলিম উল্লাহ সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের তদন্ত দলের কাছে সাক্ষ্য দেন। মঙ্গলবার গুডস হিলের বাড়ি ও গ্যারেজটি তদন্ত দলকে দেখিয়ে নির্যাতনের বিবরণ দেন তিনি।

তদন্ত দলের সদস্য সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) নুরুল ইসলাম এবং পরিদর্শক মো. ওবায়দুল্লাহ বিকাল ৪টা ৩৫ মিনিটে কড়া পাহারায় গুডস হিলে পৌঁছান। এ সময় গুডস হিল ও এর আশেপাশের এলাকায় পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়।

পরিদর্শনের সময় সাকা চৌধুরীর ছোট ভাই সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী বাড়িতে থাকলেও তিনি তদন্ত দলের সামনে আসেননি। তদন্ত দলের সদস্যরা এ সময় ছলিম উল্লাহর বক্তব্য শোনেন এবং ঘটনাস্থলের স্কেচ ম্যাপ নেন।

বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে গুডস হিল ত্যাগ করেন তদন্ত দলের সদস্যরা।

ছলিম উল্লাহ বলেন

গুডস হিলে একাত্তরের সেই নির্যাতন কেন্দ্রটি বর্তমানে পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। দোতলা ভবনটির সামনে পড়ে আছে অনেক পুরনো দুটি জিপ ও একটি প্রাইভেট কার।

১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল রাত ৮টার দিকে চট্টগ্রাম শহরের রহমতগঞ্জ এলাকা থেকে ২৮ বছর বয়সী ছলিম উল্লাহকে ধরে এই বাড়িতে নিয়ে আসে স্থানীয় আল শামস্ বাহিনীর কমান্ডার খোকা, মাহবুবসহ কয়েকজন। তার ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন।

সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী ম. ছলিম উল্লাহ তদন্ত দলকে জানান, মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে আলবদর-আল শামস্ বাহিনীর সদস্যরা নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষকে ধরে এনে এই গ্যারেজে রেখে নির্যাতন করতো। সে সময় বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে তাদের হাতে।

বর্তমানে ছলিম উল্লাহর বয়স ৬৮ বছর। গুডস হিলের সেই 'নির্যাতন কেন্দ্রের' সামনে দাঁড়িয়ে মঙ্গলবার তিনি সাংবাদিকদের জানান, নগরীর অভয়মিত্র ঘাটে তার পৈত্রিক প্রিন্টিং প্রেসের দুই কর্মচারীকে একাত্তরের সেই রাতে ধরে নিয়ে যেতে চায় আল শামস্ বাহিনীর সদস্যরা। এর প্রতিবাদ করায় তাকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

একটি জিপে করে তাদের নেওয়া হয় গুডস হিলে সাকা চৌধুরীর পৈত্রিক বাসভবনে। সেখানে একটি কক্ষে পায়ে দড়ি বেঁধে ছাদ থেকে উল্টো করে ঝুলিয়ে বেদম পেটানো হয় তাকে।

ওই সময় খোকা, মাহবুব ছাড়াও সাকা চৌধুরীর ছোট ভাই সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী ও সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমকে (সাবেক হুইপ ও বর্তমানে বিএনপি নেতা) ওই কক্ষে দেখেছিলেন বলে ছলিম উল্লাহ জানান।

পিটুনির এক পর্যায়ে সংজ্ঞা হারান ছলিম।

তিনি জানান, ওই রাতে তার সঙ্গে ওই কক্ষে আরেকজনকে রাখা হয়েছিল। আশেপাশের কক্ষগুলো থেকেও আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলেন তারা। পরদিন সকালে ছলিমের মামা অ্যাডভোকেট আবুল কাশেমের মধ্যস্থতায় নির্যাতন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পান তিনি।

ছলিম সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, তিনি কোনো রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন ছিল।

"আমি আর মৃত্যুকে ভয় পাই না। একাত্তরের সেইসব নির্যাতনের বিচার হওয়া উচিত।"

একাত্তরে সাকা চৌধুরীকে নির্যাতনের সময় দেখেছিলেন কি না- জানতে চাইলে ছলিম বলেন, "এটি তাদের পৈত্রিক বাড়ি। নির্যাতনের সময় তার ছোট ভাই সাইফুদ্দিনকে আমি দেখেছি। তবে সাকা চৌধুরীসহ ফজলুল কাদের চৌধুরীর সব সন্তানই নির্যাতনে জড়িত ছিল বলে আমি বিভিন্ন জনের কাছে শুনেছি।"