ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৩৯টি উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৫৫টি ফুটব্রিজ রয়েছে। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কিছু ফুটব্রিজে মাঝে মধ্যে লোক চলাচল দেখা গেছে। কোনোটিতে একেবারেই কেউ ওঠে না। কয়েকটি ছিন্নমূল মানুষের দখলে, কোনোটায় লোকজনকে আড্ডা দিতে দেখা গেছে। আবার বাস স্ট্যান্ড কাছাকাছি না থাকায় ব্যবহার হচ্ছে না কিছু ব্রিজ।
নগরবিদরা বলছেন, পথচারীদের পারাপারে ফুটব্রিজ টেকসই ও পরিবেশসম্মত সমাধান নয়। কিন্তু বিভিন্ন সময় মানুষের দাবির মুখে, কখনও আন্দোলন সামাল দিতে অথবা দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখাতে যত্রতত্র এসব ফুটব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে নাগরিকদের সুবিধার বিষয়টি উপেক্ষিত।
রাজধানীর ভিআইপি রোডের বেইলি রোড সিগন্যাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হল, কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনের ফুটওভারব্রিজে লোকজনের চলাচল কম।
আজিমপুর মেটার্নিটি ক্লিনিক, বুয়েটের প্রধান ফটকের ফুটব্রিজেও পথচারীদের দেখা মেলেনি। সবসময় ফাঁকা পড়ে থাকে পুরান ঢাকার নর্থ সাউথ রোডের সুরিটোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের ফুটব্রিজ। পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে সদরঘাট যেতে চিত্তরঞ্জন এভিনিউর ব্রিজটিও অব্যবহৃত পড়ে আছে।
মতিঝিলে নটরডেম কলেজ এবং মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে দুটি ফুটব্রিজ থাকলেও পথচারীদের পা পড়ে না।
সম্প্রতি প্রগতি সরণীর যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবরার নিহত হওয়ার জায়গায় একটি ফুটব্রিজ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। তবে তার কাছেই নদ্দা বাস স্ট্যান্ডে ফুটব্রিজে লোকজনের চলাচল কম।
ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে, পান্থপথের বসুন্ধরা সিটির সামনের ফুটব্রিজেও লোক পারাপার দেখা যায়নি। একই অবস্থা মিরপুর স্টেডিয়ামের সামনে, মিরপুর বাংলা কলেজের সামনের ফুটব্রিজেও।
কাছাকাছি বাস না থামায় অব্যবহৃত বিমানবন্দর সড়কের কুড়িল বিশ্বরোড ফুটব্রিজ। দেখা গেছে, নিকুঞ্জ-১ নম্বর গেট কুড়িল রেলক্রসিংয়ের মাঝামাঝি বানানো হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ফুটব্রিজ। তবে বাসগুলো সেখান থেকে ১০০ মিটার সামনে গিয়ে যাত্রী নামায়। লোকজনও আর পেছনের দিকে আসে না। ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হয়।
ফুটব্রিজ ব্যবহার করেন না কেন, জানতে চাইলে কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র তানভীর হাসান বলেন, সেটি খুব উঁচু বলে পার হন না।
“এখানে সড়ক দিয়ে সহজে পার হওয়া যায় বলে লোকজন এটাতে উঠতে চায় না। আর ফুটব্রিজ অনেক উঁচু বলে উঠতে কষ্ট হয়। আমি দুয়েকবার ব্রিজ দিয়ে পার হয়েছি।”
বুধবার কবি সুফিয়া কামাল হলের সামনের ফুটওভারব্রিজে গিয়ে কাউকে পার হতে দেখা যায়নি। কিছু ছিন্নমূল মানুষ সেখানে শুয়ে-বসে আছে। কেউ কেউ মাদকও নিচ্ছে।
তবে নিউ মার্কেট, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, বিমানবন্দর সড়কের চেয়ারম্যান বাড়ি, বনানী, কাকলী, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে, খিলক্ষেত, শ্যাওড়া, বিমানবন্দর, আজমপুর, হাউজবিল্ডিং এলাকার ফুটব্রিজ পথচারীরা ব্যবহার করেন। লোকজনের সার্বক্ষণিক চলাচল আছে বাংলামোটর, শাহবাগ, ফার্মগেট, মনিপুরীপাড়ার কলমিলতা মার্কেটের সামনের ফুটওভারব্রিজে।
পথচারীদের ইচ্ছের বাইরে অনেকটা জোর করেই তাদের ফুটব্রিজে উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন ওয়ার্ক ফর আ বেটার বাংলাদেশ, ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের গ্রোগ্রাম ম্যানেজার মারুফ রহমান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কথা চিন্তা করে এসব বানানো হচ্ছে না। ফুটব্রিজে সক্ষম লোকেরা উঠতে পারবে। কিন্তু বয়স্ক লোকজন কিভাবে পারাপার হবে?
“আমার বা-মা আর্থ্রাটিসের রোগী হতে পারেন। তারা ওই ফুটব্রিজ দিয়ে কিভাবে পার হবেন? ইন্টারসেকশনে গাড়ি থেমে থাকার জায়গার আগে পারাপারের জায়গা রাখুন। আপনি ফুটব্রিজ করবেন কেন, যানবাহনের জন্য টাইম শেয়ার করুন। দুই মিনিট পথচারী পারাপার করেন, দুই মিনিট যানবাহন পারাপার করুন।”
বুয়েটের অধ্যাপক ডা. শামসুল হকের মতে পথচারী পারাপারের জন্য ফুটব্রিজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত না।
পথচারীদের সুবিধার বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়েই ফুটব্রিজ বানানো হচ্ছে বলে মনে করেন শামসুল হক।
তিনি বলেন, বিভিন্ন আন্দোলনের ফসল হিসেবে স্পিড ব্রেকার আর ফুটব্রিজ বানানো হচ্ছে। যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কর্তৃপক্ষ একটা স্পিড ব্রেকার বানিয়ে দেয়। আর বড়সড় আন্দোলন হলে ফুটব্রিজ বানিয়ে দেওয়ার একটা সংস্কৃতি চলে এসেছে আমাদের দেশে।
“এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা হচ্ছে না। পৃথিবীর কোথাও সিগন্যালে ফুটব্রিজ বানানো হয় না। আমাদের আমলা, কর্মকর্তারা তো বিদেশে যান, তারা কেউ সিনগ্যালে ফুটওভারব্রিজ আছে এমন একটা ছবি তুলে এনে দিতে পারবেন?”
দুই মোড়ের মাঝামাঝি জায়গায় ফুটব্রিজ কার্যকর হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
গণপরিবহন ও সড়ক ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ শামসুল হক বলেন, “দুই মোড়ের মাঝখানে যদি লোকজন পারাপারের খুব চাহিদা থাকে সেখানে বানানো যেতে পারে। তবে যেসব ফুটব্রিজ আমরা বানাচ্ছি, সেগুলো না। সেটাতে চলন্ত সিড়ি, র্যাম্প থাকবে, সেটা অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। যেখানে সক্ষম-অক্ষম সবাই পারপার হবে। বানানোর পরে সার্বক্ষণিক তদারক করতে হবে।”
পৃথিবীর সব দেশে জেব্রাক্রসিং দিয়েই পথচারী পারাপার হয় বলে শামসুল হকের দেওয়া তথ্য মানলেও বাংলাদেশের বাস্তবতায় কিছু কিছু জায়গায় ফুটব্রিজ প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রাকিবুর রহমান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যারা এসব ফুটওভারব্রিজ বানিয়েছে তারা এর প্রয়োজনীয়তা দেখেই বানিয়েছে। এখন তা থেকে কতটা উপকার আমরা পাচ্ছি তা ভেবে দেখতে পারি।
“এই মুহূর্তে সবাইকে সমতলে রাস্তা ক্রস করাতে গেলে গাড়ি পারাপার আর সম্ভব হবে না। আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থা, মেট্রো, আধুনিক বাস এগুলো চালু করা সম্ভব হলে তখন হয়তো ফুটব্রিজে যাওয়ার প্রয়োজন কমে যাবে।”
তবে ভবিষ্যতে ফুটব্রিজ তৈরির আগে বিষয়গুলো সমন্বয় করা হবে বলে জানান তিনি।
রাকিবুর রহমান বলেন, “এই মুহূর্তে এটা নিয়ে স্টাডি করা নেই। আমরা ভবিষ্যতে সমন্বয়ের ভিত্তিতে এসব ফুটব্রিজ নির্মাণের চেষ্টা করছি। আমাদের কো-অর্ডিনেশন আগের চেয়ে অনেকটা বেড়েছে।”