ফুটপাতের ওপর কোথাও গাছ, কোথাও আবার বিদ্যুত বা টেলিফোনের খুঁটি, সুইচ বক্স। কোথাও ফুটপাতজুড়ে বসেছে ফুটব্রিজের খুঁটি, সিঁড়ি। আছে পুলিশ বক্সও। বিভিন্ন বিপনী বিতানের সামনে ফুটপাতের দখল নিয়েছে যানবাহন। আর হকাররাতো আছেই।
Published : 26 Mar 2019, 03:30 PM
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ ফুটপাতের নকশায় ত্রুটি আছে। ফলে দখল না হওয়া যেটকু ফুটপাত খোলা আছে, তাও অনেক ক্ষেত্রে পথচারীদের চলার উপযোগী নয়। অথচ ফুটপাত পথচারীবান্ধব হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যেত।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় ২৯২ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে, উত্তর সিটিতে আছে ২২৩ কিলোমিটার। অভিজাত এলাকার সামান্য অংশ বাদ দিলে পুরো শহরের অধিকাংশ ফুটপাতের অবস্থাই মোটামুটি এক।
মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের সামনে ফুটব্রিজের খুঁটি ও সিড়ি করা হয়েছে ফুটপাতের ওপর। তাতে পুরো ফুটপাতই দখল হয়ে গেছে। একটু ফাঁকা জায়গা দিয়ে একজন পথচারী কোনোমতে যেতে পারেন। তবে সে জায়গাটি ছিন্নমূল মানুষের প্রাকৃতিক কাজ সারার জায়গা হয়ে গেছে। সব সময় নোংরা থাকে বলে পথচারীরা সেদিক আর মাড়ান না।
সেতু ভবন থেকে আমতলী সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কের একপাশে ফুটপাত অপ্রশস্ত। দুজন পথচারী পাশাপাশি হাঁটতে কষ্ট হয়।
মহাখালী রেলক্রসিং থেকে আমতলী হয়ে কাকলী পর্যন্ত গেলে দেখা যায় ফুটপাতের বিভিন্ন অংশে থাই অ্যালুমিনিয়ামের দোকানের জিনিসপত্র রেখে কাজ করা হচ্ছে। কয়েকটি মেরামত কারখানার মোটরসাইকেলও রাখা হয় ফুটপাতে।
গুলিস্তান পার্কের দক্ষিণ পাশের সড়কে ফুটপাত বলে কিছু নেই। সড়কের একপাশ ভাঙাচোরা, সেখানে বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টার করা হয়েছে।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিটিউটের (এআরআই) হিসাবে, সারাদেশে দুর্ঘটনায় নিহতের ৪৩ শতাংিই পথচারী। আর ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে পথচারীর সংখ্যা ৪৭ শতাংশ।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ-ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মারুফ রহমান বলেন, বাংলাদেশে কর্তাব্যক্তিরা ফুটপাতকে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করেন না বলেই সেদিকে নজর দেওয়া হয় না।
“সবার আগে যদি পথচারী গুরুত্ব পায়, তাহলে সবকিছু চেইঞ্জ হয়ে যাবে। বিভিন্ন নীতিমালায় পথচারীদের জন্য অনেক কিছু করার কথা বলা আছে। কিন্তু সেইসব নীতিমালার ধারেকাছে আমরা নাই। কোনো প্রজেক্ট নাই, ধারাবাহিক কোনো কাজ নাই।”
“আমাদের ফুটপাত পথচারীবান্ধব তো নয়ই, বরং পথচারী বিরুদ্ধ পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে। পথচারীরা চরমভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে।”
বুয়েটের সহযোগী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, রাজধানীতে সড়কে নিহতদের একটি বড় অংশ রাস্তায় চলতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। ফুটপাত ব্যবহারের উপযোগী না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই পথ চলেন রাস্তার পাশ দিয়ে। ফুটপাতগুলো পথচারীবান্ধব হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমে যেত।
“আমরা বিভিন্ন সময়ে বলেছি যে ফুটপাতে রেলিং দিয়ে দেওয়া হোক, যেন লোকজন যেখানে সেখানে ফুটপাত থেকে রাস্তায় নামতে না পারে। দুই এক জায়গায় আমরা সেটা দেখলেও শহরের বেশিরভাগ প্রধান সড়কে তা হয়নি।”
অবশ্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের দাবি, ঢাকার ফুটপাত এখন আগের চেয়ে বেশি পথচারীবান্ধব। ফুটপাতে লোকজনের চলাচলও এখন বেশি।
মেয়র বলেন, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি বা বক্সগুলো সরিয়ে কোথায় রাখা যায়, সেই প্রশ্নের সুরাহা এখনও করা যায়নি।
“অন্য কোথাও যে দেব, সে জায়গা রাখা হয়নি। চেষ্টা করছি পুলিশের বক্সগুলো ফুটপাত থেকে সরিয়ে সড়ক বিভাজকের ওপর দিতে।যেখানে যাত্রী ছাউনি আছে সেখানে বাসের কাউন্টার রাখতে হবে। আমাদের কাছে বিকল্প নেই। যা আছে সেগুলোর মধ্যেই আমাদের ম্যানেজ করতে হচ্ছে। এতে পথচারীদের অবাধ চলাচল কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই।”
নীলক্ষেত-মানিক মিয়া এভিনিউ: প্রতি পদে বাধা
ঢাকার ফুটপাতের চিত্র কেমন তা রাজধানীর যে কোনো একটি সড়কের পাশের ফুটপাত ধরে হাঁটলেই বোঝা যায়। সোমবার বিকেলে নীলক্ষেত মোড় থেকে মিরপুর সড়কের মানিক মিয়া এভিনিউ সিগন্যাল পর্যন্ত ফুটপাত ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখা গেছে অব্যবস্থাপনার চিত্র।
ঢাকা কলেজের সামনে ফুটপাতে দেখা গেছে বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের দুটি সুইচবক্স। সেখানে ফুটপাতের অনেকটা এলাকা ভাঙা। টিচার্স ট্রেইনিং কলেজের সামনের ফুটপাতে ফুলের টবসহ নানা সামগ্রী নিয়ে বসেছেন হকাররা।
সড়কের ওই অংশে কথা হয় জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি-নায়েমের কর্মী ইউসুফ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ফুটপাত উন্মুক্ত থাকলে পথচারীদের সড়কে নামতে হত না।
“আমি যদি ফুটপাতে ঠিকমত হাঁটতে পারি তাহলে কেন রাস্তায় যানবাহনের মাঝখানে নামব। কেন নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেব। বাস্তবতা হল, আমাদের ফুটপাত মোটেও পথচারীদের জন্য নেই। হয়তো দখল হয়ে গেছে, নয়তো চলাচলের উপযোগী নেই।”
২ নম্বর সড়ক পার হয়ে সিটি কলেজের সামনের ফুটপাতে উঠতে হলে অনেকগুলো রিকশার বাধা ডিঙাতে হবে। হারুন আই হাসপাতালের সামনের ফুটপাতেও বিভিন্ন ব্যক্তিগত যানবাহন জড়ো হয়ে থাকে।
ধানমণ্ডি ৫ নম্বর সড়কের মাথায় কথা হয় বিশ্ববিদ্যারয় শিক্ষার্থী তানজিল আহমেদ হিমেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, কলাবাগান থেকে সিটি কলেজ পর্যন্ত যেরকম যানজট থাকে, তাতে হেঁটে আাসই ভালো। কিন্তু ফুটপাতের যা পরিস্থিতি, তাতে নির্বিঘ্নে কারও পক্ষে হেঁটে আসা সম্ভব না।
রয়েল প্লাজা, মেহের প্লাজা, ফাতেমা আর্কেড হয়ে ধানমণ্ডি প্লাজা পর্যন্ত প্রতিটি বিপনিবিতানের সামনের ফুটপাত প্রশস্ত। কিন্তু তাতে পথচারীরা হাঁটতে পারেন না। প্রতিটি মার্কেটের সামনের ফুটপাতের দখল নিয়েছে বিভিন্ন যানবাহন। এর মধ্যে সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো গাড়িও দেখা গেল।
কলাবাগান সিগন্যালে ফুটপাতের ওপর একটি পুলিশ বক্স, কাছেই ফুটব্রিজের সিঁড়ি। কলাবাগান শিশু পার্কের সামনে ফুটপাত ঘেঁষেই ডিএসসিসির বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র। সেখানে ফুটপাতের ওপর ময়লাবাহী ভ্যান, আবর্জনার বস্তা স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে ৩২ নম্বর সড়কের প্রান্ত পর্যন্ত ফুটপাতে কয়েকটি গাছ, খুঁটি চলাচলে বাধা দেয়।
মেট্রো শপিং মলের সামনে ফুটপাতের একাংশ জুড়ে ফুটব্রিজের সিঁড়ি করা হয়েছে। পাশেই পুলিশ বক্স। রাসেল স্কয়ার থেকে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর পর্যন্ত ফুটপাতে কোনো দখলদার নেই। তবে ফুটপাত সড়ক থেকে অনেক উঁচুতে। কিছুদুর গিয়ে নামতে-উঠতে হয়।
সেখানে চলতি পথের এক যাত্রী বললেন, “আসলে যারা এগুলোর দায়িত্বে, তাদের তো আর আমাদের মত রাস্তায় হাঁটতে হয় না। তাই আমাদের কষ্টটাও তারা বুঝতে চান না। প্রতিবন্ধীদের জন্য সবাই কত ভালো ভালো কথা বলে। এই রাস্তায় এই ফুটপাতে তারা কীভাবে চলবে তা কেউ ভাবে?”