সাক্ষাৎকারপ্রতিশ্রুতি রাখতে হবে ভারতকে: শ্রীরাধা দত্ত

"এই মুহুর্তে ভারতের অজুহাত দেখানো বন্ধ করা এবং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশকে সব দেয়া উচিত।"

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Sept 2011, 05:08 AM
Updated : 12 Sept 2011, 05:08 AM
শ্রীরাধা দত্ত ভারতের শীর্ষস্থানীয় বাংলাদেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। তিনি কলকাতার মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজের প্রধান। এর আগে তিনি কাজ করেছেন নয়া দিল্লির ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস-এ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পর এ নিয়ে শ্রীরাধা দত্তের সঙ্গে কথা বলেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রদায়ক সম্পাদক এস এন এম আবদি।
প্রশ্ন: ড. সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের ফলাফলে আপনি কতটুকু হতাশ?
উত্তর: আমি অনেকটাই হতাশ। আর কল্পনা করুন, বাংলাদেশীদের হতাশার পরিমাণটা। শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে সহযোগিতামূলক আচরণ করেছেন। তাই তার ২০১০ সালের জানুয়ারিতে তার ভারত সফরের পর বাংলাদেশের প্রত্যাশা ছিল ব্যাপক। ঢাকা আশা করেছিল, ভারত ভালোভাবে সাড়া দেবে। কিন্তু তাদের এই আশা শেষ মুহুর্তে এসে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে।
প্রশ্ন: এক থেকে দশের মধ্যে আপনি এই শীর্ষ সম্মেলনকে কত দেবেন?
উত্তর: পাঁচ এর মতো।
প্রশ্ন: আর যদি তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হতো?
উত্তর: পানি চুক্তি হলে আমি আটের বেশি দিতাম।
প্রশ্ন: ড. সিংয়ের এতো প্রত্যাশার এই সফর এতো গড়বড়ে হয়ে গেল কেন? আপনার কী মনে হয়?
উত্তর: বাংলাদেশে পানি চুক্তিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। এটা তাদের জন্য খুবই স্পর্শকাতর ও আবেগের বিষয়। এই পানি একটা সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে পারে আবার ফেলেও দিতে পারে। আমরা অনেক ইস্যুতে একমত হতে না পারলেও পানি চুক্তিটি স্বাক্ষর করে ফিরতে পারলে বাংলাদেশের জনমত ভারতের দিকে থাকতে পারত। যাই হোক, সহযোগিতার ওপর রূপরেখা চুক্তি দুই দেশ ও এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারবে।
সফরটি জটিল হয়ে পড়েছিল কারণ এটি ঘুরছিল তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির ওপর। একটা শীর্ষ বৈঠকে আরও অনেক বেশি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা উচিত ছিল। তবে আমরা প্রধানমন্ত্রীকে কেন পাঠালাম? উচ্চ পর্যায়ের অনেক সফর তো হামেশাই হচ্ছে।
প্রশ্ন: প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফরে আসতে অস্বীকার না করেও মমতা বন্দোপাধ্যায় তার দাবি তুলে ধরতে পারতেন। আপনার কী মত?
উত্তর: মমতার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফরে না যাওয়ার কোনো কারণ দেখি না আমি। তিস্তা চুক্তি নিয়ে তার আপত্তির অবশ্য কিছু যৌক্তিক কারণ আছে। কিন্তু তা সত্ত্ব্ওে এই সফরে না যাওয়াটা তার ঠিক হয়নি। ড. সিংয়ের মতো তিনিও হাসিনাকে হতাশ করেছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ। পশ্চিম বঙ্গের যে কোনো মূখ্যমন্ত্রী সম্পর্কটি টিকিয়ে রাখতে চাইবেন। হাসিনা আর মমতা এত ঘনিষ্ঠ যে, মমতা নির্বাচনে জেতার পর হাসিনা প্রটোকলের ধার ধারেননি, তিনি ফোন তুলে মমতাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এ কথা মনে রেখেও মমতার হাসিনার ঢাকায় যাওয়া উচিত ছিল।
এমনকি তিস্তা চুক্তি না হলেও তার ঢাকায় যাওয়া উচিত ছিল। তার উপস্থিতি উত্তেজিত øায়ুর ওপর মলমের মতো কাজ করত। আরেকটু মধুর স্বাদ নিয়ে শীর্ষ বৈঠকটি শেষ হতে পারতো।
প্রশ্ন: এই ব্যর্থতার জন্য অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর অফিসকে দোষারোপ করছে। আপনি কি মনে করেন, জটিল দ্বিপাক্ষিক ইস্যুগুলো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভালো সামলাতে পারতো?
উত্তর: আমি তাই মনে করি। জটিল দ্বিপাক্ষিক ইস্যুগুলো অনেক ভালো বোঝে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারাই সবসময় এগুলো সামলেছে।
প্রশ্ন: পেশাদার কূটনীতিক পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জনা মাথাই বলেছেন, তিনি এবং জ্যোতি বসু ১৯৯৬ সালে গঙ্গা চুক্তির আগে নৌকা ভ্রমণে পর্যন্ত গেছেন। এবং সে সময় ঢাকায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার দেব মুখার্জী জানিয়েছেন, বসু চুক্তির প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে জানতে চেয়েছেন, এমনটি গঙ্গা চুক্তির খসড়া তৈরি হওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশ সফর করেছেন।
উত্তর: আমি জানি জ্যোতি বসু চুক্তিটি হওয়ার জন্য চাপ দিয়েছেন। তিনি সহযোগিতার চেয়েও বেশি কিছু করেছেন। ২০১১ সালেও নয়া দিল্লি আশা করেছিল মমতা সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন। এই বিশ্বাস ব্যর্থতার সূচনা করে।
প্রশ্ন: ড. সিংয়ের হয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন মমতার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। পশ্চিম বঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর হিলারি ক্লিনটন সেখানে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেনন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পশ্চিম বঙ্গের বদলে চেন্নাই পাঠিয়েছিলেন। মমতা সে থেকে আর মেননকে ক্ষমা করেননি।
উত্তর: (কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর) আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না।
প্রশ্ন: এই হতাশাজনক সফরের পর ভবিষ্যতে উত্তরণের উপায় কী?
উত্তর: বাংলাদেশ ও ভারতের মূল উদ্বেগগুলো নিয়ে চুক্তিতে পৌঁছুতে দুই দেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এগুলোর মধ্যে পানি অন্যতম। ভারত তাকিয়ে আছে কঠিন হয়ে পড়া সংযোগ এবং প্রর্ত্যপণ চুক্তি স্বাক্ষরের দিকে।
এই শীর্ষ বৈঠকের একমাত্র ইতিবাচক ফল হল সীমান্ত ইস্যুগুলো নিয়ে চুক্তির পদক্ষেপ। এর মধ্যে আছে বিরোধপূর্ণ ছয় দশমিক ১ কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিত করা এবং ছিটমহল ও দুই দেশের অবৈধ দখলে থাকা এলাকা বিনিময় করা।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টি বাংলাদেশ দেখেছে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ভারত ও বাংলাদেশ নিরাপত্তা বিষয়ক তিনটি চুক্তি সাক্ষর করেছে। কিন্তু প্রত্যর্পণ চুক্তি বাকি ছিল। দিল্লি আর ঢাকার ভালো সম্পর্ক থাকায় সবাই আশা করছে এই চুক্তিটিও স্বাক্ষরিত হবে।
প্রশ্ন: এটা কি ইটের বদলে পাটকেল নয়? ভারত পানি চুক্তি পিছিয়ে দিয়েছে বলে বাংলাদেশও কি ট্রানজিট ও প্রত্যর্পণ চুক্তি আটকে দিয়েছে?
উত্তর: আমি মনে করি না এখানে ইটের বদলে পাটকেল ছোড়া হয়েছে। দুই দেশের সরকার এত অপক্ক নয় যে, তারা প্রতিশোধপরায়ণ হবে। তবে আমি মনে করি, হাসিনার হাত বাঁধা ছিল কারণ, তাকে জনগণকে দেখাতে হতো যে ভারত কিছু পাওয়ার আগে কিছু দিয়েছে।
বাংলাদেশের পক্ষে বলতেই হয় যে, তারা ইতিমধ্যেই ত্রিপুরার পালাটনে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য কলকাতা বন্দর থেকে ভারি কন্টেইনার আনতে আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করতে দিয়েছে। এই ট্রানজিট সুবিধা এক বছরের বেশি সময় ধরে পাচ্ছে ভারত। এটা অবশ্য বড় ও ভারি যন্ত্রপাতি পালাটন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য একবারের জন্য ছাড়।
বাংলাদেশে এক হাজার থেকে পনেরশ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি আছে। পালাটান বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লক্ষ্যগুলোর একটি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করা।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ অনুপ চেটিয়াকে ভারতে ফেরত পাঠানো তো আটকে দিয়েছে।
উত্তর: অনুপ চেটিয়াকে পাতে তুলে দিলে তো সব সমস্যার সমাধান হবে না। তবে তা হবে একটা বিরাট ধরণের প্রতীকি ছাড়। তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় বিষয়টি ঝুলে গেল।
হয়তোবা বন্ধু দেশের মধ্যে আসলে প্রত্যর্পণ চুক্তির প্রয়োজনও নেই। তারা চুপচাপ পলাতকদের হস্তান্তর করতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের ভালো অভিপ্রায় ভারতের জানা আছে।
প্রশ্ন: অনেকেই পরামর্শ দিয়েছেন যে, মমতা ও বাংলাদেশের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য ড. সিংয়ের উচিত একজন বড় রাজনীতিককে নিয়োগ করা যাতে দুই পক্ষের জন্যই মানানসই তিস্তা চুক্তি তিন মাসের মধ্যে স্বাক্ষর হয়।
উত্তর: এটা একটা ভালো ধারণা। বাংলাদেশকে যখন শান্ত করা দরকার তখন এটা সঠিক বার্তাই পৌঁছাবে। সঞ্চালকের ভূমিকায় থাকা একজন রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের সঙ্গে ভালোই কাজ করবে। একজন রাজনীতিক সম্ভবত একজন আমলার চেয়ে কুশলতার সঙ্গে পার্থক্যগুলো ঘুচাতে পারবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে দিনে দিনে ভারতকে দেখা হচ্ছে আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে, যারা কথা দিয়ে কথা রাখে না। এর মধ্যে সবচেয়ে সা¤প্রতিকটি হল তিস্তা চুক্তি না করা। এমনকি ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর প্রতিশ্র"ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ এবং পাঁচ লাখ টন চাল দেওয়ার প্রতিশ্র"তি চার বছর ধরে মরীচিকা হয়ে আছে।
উত্তর: প্রতিশ্র"তি বাস্তবায়ন না করার সমস্যা ভারতের আছে বলেই মনে হচ্ছে। এই মুহুর্তে ভারতের অজুহাত দেখানো বন্ধ করা এবং প্রতিশ্র"তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে সব দেয়া উচিত।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, শরীফ উল্লাহ