ভোরের ঠিক আগে অপরিসর গলিতে হাজার খানেক নারী-পুরুষের ভিড়, তিন ফুট প্রশস্ত ফটক দিয়ে আগে ঢোকার মরিয়া চেষ্টা, ভিড় সামলাতে লাঠিপেটা, হুড়োহুড়ি এবং মারামারি- এই ছিল ময়মনসিংহে পদদলনে মৃত্যুর দৃশ্যপট।
Published : 10 Jul 2015, 08:47 PM
শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে ময়মনসিংহ পৌরসভা কার্যালয়ের কাছে অতুল চক্রবর্তী রোডে নূরানী জর্দা কারখানার ফটকে এ ঘটনায় জাকাতের কাপড় নিতে এসে লাশ হয়ে ফিরেছেন ২৭ জন নারী ও শিশু, আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক।
নূরানী জর্দা কারখানার মালিক শামীম তালুকদার প্রতি বছরই জাকাত দেন। এবারও সেজন্য গত কয়েক দিন এলাকায় মাইকিং করা হয়। জাকাত নিতে আসার জন্য ‘কার্ড’ও বিতরণ হয়েছিল বলে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
জাকাতের কাপড় নিতে মধ্যরাত থেকেই শামীমের চারতলা কারখানা ও বাসার সামনে জড়ো হতে থাকেন আশেপাশের বস্তির দুস্থ বাসিন্দারা। তাদের অধিকাংশের বসবাস বিহারি ক্যাম্প, থানাঘাট ও শহরের বিভিন্ন বস্তিতে। এমনকি ব্রহ্মপুত্রের চর থেকেও অনেকে আসেন জাকাতের কাপড়ের আশায়।
সেহেরির পরপর নূরানী কারখানার বন্ধ ফটকে বাড়তে থাকে অস্থিরতা। ভিড়ের চাপে অতিষ্ট হয়ে অনেকেই চিৎকার করে গেইট খুলে দিতে বলেন। শেষ পর্যন্ত বড় ফটকের সঙ্গে লাগোয়া ছোট ফটক খুলে দিতেই সবাই হুড়মুড় করে ঢোকার চেষ্টা করেন বলে জানান ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর সিতরা ইউনিয়নের আনন্দিপুর গ্রামের জাবিনা বেগম ও চর ঈশ্বরদিয়ার মাহামুদা খাতুন।
জাকাত নিতে ভোর রাতে এই গলিতেই ভিড় করেছিলেন সহস্রাধিক মানুষ
হাসপাতালের বাইরে পদদলনের ঘটনার বিবরণ দেন প্রত্যক্ষদর্শী এক নারী
এরপর রিকশা ও ভ্যানে করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছাতে থাকে একের পর এক লাশ। কারখানার সামনে পড়ে থাকে বহু মানুষের ছেঁড়া পাদুকা।
ময়মনসিংহ মেডিকেলের চিকিৎসক ফাহাদ হোসেন জানান, যাদের লাশ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে, তাদের মৃত্যু হয়েছে ভিড়ের চাপে শ্বাসরোধ হয়ে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজনহারা অনেকেই বলেছেন, কারখানার লোকজন আগে বড় ফটক খুলে দিয়ে সময়মত শৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টা করলে এ ঘটনা ঘটত না।
থানাঘাট বস্তির বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম জানান, বাড়ির দারোয়ান দুই পাশে বাঁশ বেঁধে ফটকের সামনে লাইনে দাঁড়ানো মানুষের চাপ সামলানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ফটক খোলার পর কোনো কিছুই আর নিয়ন্ত্রণে থাকেনি।
একই বস্তির আয়েশা খাতুন বলেন, “আমরারে তো ঢুকাইছে এই সাইডের গেইট দিয়া, হেই সাইডে খুব মারামারি হইতাছে,... লাস্টে পরে আমি মাইর খাইয়া ওয়ালের ওপরে দিয়া নামছি। আমি নাইম্মা গিয়া দুই বেডিরে টান দিয়া বাইর করছি। বাইর কইরা হাইরা বেডির মাথায় পানি দিছি। আর নাহে ধইরা হাইরা দমডা ইয়া কইরা দিছি।”
পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টায় কারখানার কর্মচারীরা যাকাতপ্রার্থীদের পিটিয়ে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন বলে আরও কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
এক নারীর লাশ নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে স্থানীয় এক বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যহন গেইট খুলছে, তহন পাড়াপাড়ি কইরা গেছে তো, মানে ধাক্কাধাক্কি কইরা গেছে, পইড়া গেছে। একজন পড়াতে আরও ১৫-২০ জন পড়ছে। পাড়া লাগছে, পাড়ার চোটে মারা গেছে।”
লাঠিপেটা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি কামরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হতে পারে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে হবে।”
ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার (এসপি) মইনুল হক বলেন, “যারা জাকাত দিচ্ছিলেন, তারা আগে থেকে পুলিশকে কিছু জানাননি। আর অনেক ভোরে ঘটনা ঘটায় পুলিশ আগে কিছু জানতেও পারেনি।”
পুলিশ বা জনপ্রতিনিধিদের না জানিয়ে কারখানা মালিক দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন জেলা প্রশাসক মুত্তাকীম বিল্লাহ ফারুকিও।
নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসন ১০ হাজার ও ধর্ম মন্ত্রণালয় ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
নূরানী জর্দ্দা কারখানার মালিক শামীম তালুকদার
ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মইনুল হক
বাকি ছয় আসামি হলেন- কারখানার ম্যানেজার ইকবাল হোসেন, শামীমের আত্মীয় আরমান হোসেন, আলমগীর হোসেন, কারখানার কর্মচারী শামসুল ইসলাম আবদুল হমিদ ও গাড়ি চালক পারভেজ।
পদপিষ্ট হয়ে হতাহতের কারণ খতিয়ে দেখতে পুলিশ ও জেলা প্রশাসন দুটি তদন্ত কমিটি করেছে। এর মধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা ময়মনসিংহে পৌঁছে কাজও শুরু করেছেন।
অতিরিক্ত উপ মহা পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম নেতৃত্বাধীন এই তদন্ত দল দুপুরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য শোনেন এবং ঘটনা সম্পর্কে জানতে চান।
তবে অবহেলার অভিযোগ অস্বীকার করে শাহীন তালুকদারের ছেলে হেদায়েত থানায় সাংবাদিকদের বলেন, “৩৫ বছর ধরে এ রকমভাবে দেওয়া হচ্ছে। কার্ড নিয়ে আসে, নিয়ে যায়। একসাথে কখনো একশজন হতে পারে ম্যাক্সিমাম। কিন্তু এরকম হাজার আসবে, দুইশ-পাঁচশ আসবে এরকম তো খুব কমই আসে।”