ময়মনসিংহে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে পদদলিত হয়ে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের সবাই নারী ও শিশু।
Published : 10 Jul 2015, 08:23 AM
কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি কামরুল ইসলাম জানান, শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে ময়মনসিংহ শহরের অতুল চক্রবর্তী রোডে ব্যবসায়ী শামীম তালুকদারের নূরানী জর্দা কারখানায় এ ঘটনা ঘটে।
কারখানা মালিক শামীমসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছে পুলিশ; গঠন করা হয়েছে দুটি তদন্ত কমিটি।
ওসি বলেন, “অতিরিক্ত মানুষের ভিড়ের কারণে সেহেরির পর কারখানার গেইট খোলার সঙ্গে সঙ্গে বহু নারী-পুরুষ একসঙ্গে ঢোকার চেষ্টা করেন। এতে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে পদদলিত হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে।”
এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। তাদের মধ্যে চারজনকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, নূরানী জর্দার মালিক শামীম তালুকদার প্রতি বছরের মতো এবারও জাকাত দেওয়ার কথা কয়েক দিন ধরে এলাকায় মাইকে প্রচার করেন। ওই খবর শুনে মধ্যরাত থেকে আশপাশের বিহারি ক্যাম্প, থানাঘাট ও বিভিন্ন বস্তির বাসিন্দারা ময়মনসিংহ পৌরসভা কার্যালয়ের কাছে শামীমের কারখানা ও বাসভবনের সামনে জড়ো হন।
এক পর্যায়ে ভিড়ের চাপে ফটক খুলে দিতেই সবাই হুড়মুড় করে ঢোকার চেষ্টা করলে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে ফটকের ভেতরে লাঠিপেটা শুরু করেন কারখানার কর্মচারীরা। কিন্তু ধাক্কাধাক্কিতে কয়েকজন পড়ে গেলে পদপিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই নারী ও শিশুদের মৃত্যু হয়।
হাসপাতালের বাইরে নিহত এক নারীর স্বজনদের আহাজারি
হাসপাতালের বাইরে পদদলনের ঘটনার বিবরণ দেন প্রত্যক্ষদর্শী এক নারী
এক নারীর লাশ নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে স্থানীয় এক বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যহন গেইট খুলছে, তহন পাড়াপাড়ি কইরা গেছে তো, মানে ধাক্কাধাক্কি কইরা গেছে, পইড়া গেছে। একজন পড়াতে আরও ১৫-২০ জন পড়ছে। পাড়া লাগছে, পাড়ার চোটে মারা গেছে।
এদিকে ঘটনার পর অধিকাংশ লাশ ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল থেকে স্বজনরা নিয়ে যাওয়ায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হয়।
সকালে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে বলা হয়, তারা ২৭ জনের মৃত্যুর খবর পেলেও সব লাশ তাদের হাতে নেই। পরে পুলিশ ও জেলা প্রশাসকের বক্তব্যে লাশের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
নিহতদের তালিকা হওয়ার পর বিকালে ২৫ জনের লাশ হস্তান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত করেন পুলিশ সুপার মইনুল হক। রাতে সদরের ইউএনও আ ন ম সাইদুল হক পদদলিত হয়ে নিহত আরও দুইজনের লাশ দাফনের কথা জানান।
পুলিশ সুপার বলেন, “যারা জাকাত দিচ্ছিলেন, তারা আগে থেকে পুলিশকে কিছু জানাননি। আর অনেক ভোরে ঘটনা ঘটায় পুলিশ আগে কিছু জানতেও পারেনি।”
এ ঘটনায় আহতদের মধ্যে চারজনকে ময়মনসিংহ মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। এরা হলেন - আকুয়া দক্ষিণপাড়ার হেনা (৫৫), আকুয়া মোড়লপাড়ার ময়না (৭০), পাটগুদামের রাজ (২০) ও চরখরিচার রাসেল (২৫)।
হত্যা মামলা
পদদলনের ঘটনার পরপরই নূরানী জর্দা কারখানার মালিক শামীম তালুকদার ও তার ছেলে হেদায়েত হোসেন তালুকদারসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সন্ধ্যায় কোতোয়ালি মডেল থানায় তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয় বলে ওসি কামরুল ইসলাম জানান।
বাকি ছয়জন হলেন- কারখানার ম্যানেজার ইকবাল হোসেন, শামীমের আত্মীয় আরমান হোসেন, আলমগীর হোসেন, কারখানার কর্মচারী শামসুল ইসলাম আবদুল হমিদ ও গাড়িচালক পারভেজ।
জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলিতদের উদ্ধার করে নেওয়া হচ্ছে হাসপাতালে।
নূরানী জর্দা কারখানার বাইরে পড়ে থাকা স্যান্ডেল
তদন্ত কমিটি
এ ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে পুলিশ সদর দপ্তর ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুল ইসলামকে প্রধান করে গঠিত পুলিশ সদর দপ্তরের তিন সদস্যের কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
আর ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের ১ সদস্যের তদন্ত কমিটির দায়িত্ব পেয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মল্লিকা খাতুন। তাকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে হবে।
পুলিশের তদন্ত কমিটির সদস্যরা ইতোমধ্যে ময়মনসিংহে পৌঁছে কাজ শুরু করেছেন। তারা দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্যও শুনেছেন।
নিহত যারা
পদদলনে নিহতদের মধ্যে ২২ জনের পরিচয় জানা গেছে। এরা হলেন- ময়মনসিংহ শহরের চরপাড়ার হায়দার আলীর স্ত্রী হালিমা বেগম (৪৫), আকুয়া মোড়লপাড়ার জালাল উদ্দিনের স্ত্রী নাজমা বেগম (৫০),আব্দুস সালামের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৫৫) ও ইসমাইলের স্ত্রী জোহরা খাতুন (৪০), কাঠগোলা বাজারের আব্দুল মজিদের স্ত্রী রেজিয়া আক্তার (৪০), আকুয়া দক্ষিণপাড়ার রবি হোসেনের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৪২), চরঈশ্বরদিয়ার লাল মিয়ার স্ত্রী সুফিয়া বেগম (৬০), থানাঘাটের আব্দুস সালেকের স্ত্রী খোদেজা বেগম (৫০), ব্রহ্মপুত্র বাস্তুহারা বিহারি ক্যাম্পের সিরাজুল ইসলামের ছেলে সিদ্দিক (১২), সখিনা বেগম (৪০), মেয়ে লামিয়া (৫), আব্দুল বারেকের স্ত্রী সামু বেগম (৬০), কাচারিঘাটের মাহতাব উদ্দিনের স্ত্রী ফজিলা বেগম (৭৫), পাটগুদাম বিহারি ক্যাম্পের লালু মিয়ার স্ত্রী হাজেরা বেগম (৭০), শহরের মৃত্যুঞ্জয় স্কুলরোড বসাকপট্টির গোবিন্দ বসাকের স্ত্রী মেঘনা বসাক (৩৫), তারাকান্দা উপজেলার মালিডাঙ্গা গ্রামের মোসলেমের স্ত্রী মরিয়ম (৫০), শহরের ধোপাখলার মৃত সুলতানের স্ত্রী জামিনা খাতুন (৬৫), গরেন্দ্রের স্ত্রী রিনা রানী (৬০) ও নারায়ণ চন্দ্র সরকারের স্ত্রী সুধা রানী সরকার, নাজমা আক্তার (৬০) সদর উপজেলার খাদিজা খাতুন (৫৫) ও বৃষ্টি রানী (১২)।