চট্টগ্রাম বন্দরে আটক কোকেন ‘যাচ্ছিল’ ভারতে

জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়লেও কন্টেইনারে সূর্যমুখী তেলের সঙ্গে মেশানো কোকেনের গন্তব্য ভারত ছিল বলে শুল্ক গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছেন।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 June 2015, 02:06 PM
Updated : 7 July 2015, 02:43 PM

এই কোকেন পাচারে বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে যুক্তরাজ্য ও বলিভিয়ার মাদক চোরাচালানিরাও জড়িত বলে তাদের ধারণা।

পাচারে জড়িত সন্দেহে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে চারজনকে আটক করা হয়েছে। নাম এসেছে যুক্তরাজ্য প্রবাসী এক বাংলাদেশির এবং ভারতের কলকাতার এক নাগরিকের।

বলিভিয়া থেকে আসা ওই কন্টেইনারে সূর্যমুখী তেলের সঙ্গে মিশ্রিত কী পরিমাণ কোকেন রয়েছে, তা নিশ্চিত হতে পারেনি এই অভিযান চালানো শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

১৮৫ কেজি ওজনের ওই ড্রামের এক-তৃতীয়াংশ তরল কোকেন বলে ধারণা করছেন শুল্ক গোয়েন্দারা। সেই হিসেবে ৬০ কেজি কোকেন থাকতে পারে ওই কন্টেইনারে।

চট্টগ্রাম বন্দরে কায়িক পরীক্ষায় ওই কন্টেইনারের ১০৭টি ড্রামের কোনোটিতে কোকেন থাকার প্রমাণ না পাওয়ার পর নমুনা পাঠানো হয় ঢাকায় বিসিএসআইআর ও ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে, তাতে মেলে মাদকের অস্তিত্ব।

এরপর মামলা ও তদন্ত কমিটি গঠনের পর চারজনকে গ্রেপ্তার করে মঙ্গলবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে আসেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মঈনুল খানসহ কর্মকর্তারা।

তিনি বলেন, এই কোকেন পাচারে বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল চোরাচালানিদের।

এই কন্টেইনারটি জব্দের পর গত ৭ জুনও মঈনুল খান বলেছিলেন, কনটেইনারটির লক্ষ্য বাংলাদেশ নয়। কোনো একটি চক্র বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে বলে দালিলিক প্রমাণ রয়েছে।

“কারণ আমদানির পর ২৫ দিনেও যে প্রতিষ্ঠানের নামে কনটেইনার এসেছে, তারা এটির মালিকানা দাবি করেনি। পাশাপাশি তৃতীয় একটি পক্ষ কনটেইনারটি অন্য একটি দেশে পুনঃরপ্তানির চেষ্টা করে।”

বন্দর কর্মকর্তারা জানান, বলিভিয়া থেকে আমদানি করা সূর্যমুখী ভোজ্যতেলবাহী কনটেইনারটি জাহাজীকরণ হয় উরুগুয়ের মন্টিভিডিও বন্দর থেকে। সেখান থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে গত ১২ মে কনটেইনারটি এসে পৌঁছায় চট্টগ্রাম বন্দরে।

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের খান জাহান আলী লিমিটেডের নামে কনটেইনারটি আমদানি করা হলেও বন্দরে আসার পর এর মালিকানা কেউ দাবি করেনি। খান জাহান লিমিটেডের মালিক নুর মোহাম্মদ দাবি করেন, তার এক কর্মচারী এটি এনেছে। এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে খান জাহান আলীর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান প্রাইম হ্যাচারির ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা সোহেলকে আটকের পর বন্দরের ইয়ার্ডে থাকা কনটেইনারটি জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে শনাক্ত করে পুলিশ।

আটক মোস্তফা কামাল (বাঁয়ে) ও আতিকুর রহমান খান

গ্রেপ্তার গোলাম মোস্তফা সোহেল আদালতে

সোহেলের পর মঙ্গলবার ঢাকায় আটক তিনজন হলেন- গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মণ্ডল গ্রুপের বাণিজ্যিক নির্বাহী আতিকুর রহমান খান, কসকো বাংলাদেশ শিপিং লাইনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (করপোরেট, বিক্রয় ও বিপণন)  এ কে আজাদ এবং মোস্তফা কামাল নামের এক ব্যক্তি।

তদন্তকারীরা বলছেন, মোস্তফা কামালের আত্মীয় বকুল মিয়া এই ‘পাচারচক্রের’ হোতা, যিনি থাকেন যুক্তরাজ্যে। রাজু নামের এক ভারতীয়ও এর সঙ্গে জড়িত।  

সংবাদ সম্মেলনে মঈনুল খান বলেন, আতিক ও মোস্তফা কামাল বন্ধু। যুক্তরাজ্যে থাকা বাংলাদেশি বকুল সম্পর্কে কামালের ভাই।  

“চট্টগ্রামে ভোজ্যতেল ঘোষণা দিয়ে আনা কোকেন যেন বাংলাদেশে খালাস না হয় সেজন্য আতিক ও মোস্তফাকে নিয়োগ করেছিল বকুল। তারা এটা ভারতের নাগরিক রাজুর সঙ্গে যোগাযোগ করে কলকাতায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল।”

সংবাদ সম্মেলনে মঈনুল খান

কোকেনের চালানটি যেদিন ধরা পড়ে, সেদিন রাজুর বাংলাদেশে আসার কথা ছিল বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন।

বকুল মাদক চোরাচালানের আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য পেয়েছেন জানিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হুসাইন আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তার বিষয়ে ব্রিটিশ হাইকমিশনে জানানোর কথা ভাবা হচ্ছে। ব্রিটিশ পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরও তথ্য পেয়ে যেতে পারে।

কোকেনের চালানটি সরাসরি ভারতে না নিয়ে বাংলাদেশে আনার কারণ ব্যাখ্যা করে এক শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানিদের কৌশল হল বিভিন্ন দেশ ঘুরে মাদক বহন করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানো।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “ধরুন, বলিভিয়ায় কোনো কোকেনের চালান সরাসরি আমেরিকা গেলে তাতে অনেকবার তল্লাশি করা হতে পারে। তবে বাংলাদেশ কিংবা ভারত হয়ে কোনো পণ্য গেলে অনেক সময় সেখানকার কর্তৃপক্ষ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখবে না। কারণ বাংলাদেশ-ভারত এসব দেশে কোকেন সহজলভ্য নয় বা এখানে কোকেনের উৎপাদন কিংবা বাজার নেই।”

মঈনুল খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোকেন চোরাচালানে চারটি দেশের সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। ঘটনাটি তদন্ত করতে গিয়ে হুমকি আসলেও আমরা ভীত নই।”

৬০ কেজি কোকেন থাকার ধারণা

চট্টগ্রাম বন্দরে আটক সূর্যমুখী তেলের চালানে যে তরল কোকেন পাওয়া গেছে, তাতে ৬০ কেজি কোকেন রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন শুল্ক গোয়েন্দারা।

কনটেইনারে থাকা নীল রঙের ড্রামগুলোর গায়ে লেখা ছিল ‘অ্যাসাইট গিরাসল সানফ্লাওয়ার অয়েল’, ওজন- ১৮৫ কেজি।

১০৭টি ড্রামের মধ্যে ৯৬ নম্বর ড্রামটিতে তরল কোকেনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

মঈনুল খান বলেন, আপাতত বলা যাচ্ছে না, তবে এর মধ্যে ৬০ কেজি কোকেন থাকতে পারে।

ফাইল ছবি

“কনটেইনারের কতটুকু কোকেন ছিল, তা জানতে জাতিসংঘের ইউএনওডিসির (ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম) ভারত কার্যালয়ে এরই মধ্যে যোগাযোগ করেছি। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ ইউএনওডিসি থেকে জানতে পারব, কতটুকু কোকেন রয়েছে।”

বাংলাদেশে কোকেন সহজলভ্য নয় জানিয়ে মঈনুল খান বলেন, “কনটেইনারে কী পরিমাণ কোকেন রয়েছে, তা নির্ণয়ে পরীক্ষাগারে ৫০ মিলিগ্রাম কোকেনের দরকার ছিল। আমরা তা জোগাড় করতে পারিনি। তাই এখনও কতটুকু কোকেন পাওয়া গেয়েছে, তা বলা যাচ্ছে না।”

গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোকেনের দাম বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। মানভেদে কেজিপ্রতি দাম ৫০ হাজার, ৫ লাখ আবার কোটি টাকায়ও ওঠে।

কোকেন আটকের পর খান জাহান আলী লিমিটেডের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ ও সোহেলকে আসামি করে চট্টগ্রামের বন্দর থানায় একটি মামলা করেছে পুলিশ। সোহেলকে মঙ্গলবার পুলিশ রিমান্ডে নিলেও নুর মোহাম্মদ লাপাত্তা। 

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি কমিটিও করা হয়েছে। আরও ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়া চলছে বলে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হুসাইন আহমেদ জানান।