মুজাহিদের প্রাণদণ্ড বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলার চূড়ান্ত রায়ে আলবদর বাহিনীর প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ এসেছে বুদ্ধিজীবী  হত্যার পরিকল্পনা ও সহযোগিতার দায়ে।

মহিউদ্দিন ফারুকও কাজী শাহরিন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 June 2015, 03:16 PM
Updated : 16 June 2015, 06:00 PM

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন-বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের আপিল আংশিক মঞ্জুর হলেও বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত রায়েও বহাল রাখা হয়।

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মুজাহিদের বিচার শুরু হয়েছিল ২০১২ সালের ২১ জুন। এর এক বছর পর ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই এই জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে।

ওই রায়ে প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে মুজাহিদকে দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল। ১, ৬ ও ৭ নম্বর অভিযোগে তার ফাঁসির আদেশ হয়। ৫ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন ও ৩ নম্বর অভিযোগে তার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়।

আপিল বিভাগের রায়ে মুজাহিদকে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ বহাল রাখা হয়েছে ষষ্ঠ অভিযোগে।

অভিযোগ ৬: একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ক্যাম্প করে। সেখানে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা হয়। পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের শীর্ষ নেতা মুজাহিদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল সেখানে। তিনি ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। এ ধরনের ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়েই ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী নিধনসহ গণহত্যার মতো ঘটনা সংঘটিত হয়।

৭ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ তার সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে।

অভিযোগ ৭: একাত্তরের ১৩ মে মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালিয়ে বীরেন্দ্র সাহা, নৃপেন সাহা, শানু সাহা, জগবন্ধু মিত্র, জলাধর মিত্র, সত্য রঞ্জন দাশ, নরদবন্ধু মিত্র, প্রফুল্ল মিত্র, উপেন সাহাকে আটক করে। পরে উপেন সাহার স্ত্রী রাজাকারদের স্বর্ণ ও টাকার বিনিময়ে স্বামীর মুক্তি চাইলেও মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকাররা সবাইকেই হত্যা করে। একই সময়ে রাজাকাররা সুনীল কুমার সাহার কন্যা ঝর্ণা রানীকে ধর্ষণ করে। হিন্দুদের বসতঘরে লুটপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া অনীল সাহা নামে একজনকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়।

মামলার পঞ্চম অভিযোগে মুজাহিদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। চূড়ান্ত বিচারে এ অভিযোগে সেই সাজাই বহাল রেখেছে সর্বোচ্চ আদালত।

দুটি অভিযোগে যাবজ্জীবন হলেও ছয় নম্বর অভিযোগে সর্বোচ্চ সাজার রায় আসায় এই জামায়াত নেতার ক্ষেত্রে প্রাণদণ্ডই প্রযোজ্য হচ্ছে। 

অভিযোগ ৫: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, গেরিলা যাদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল, শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছেলে শাফি ইমাম রুমি, বদিউজ্জামান, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ও মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদসহ কয়েকজনকে আটক করে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে রাখা হয়। ৩০ অগাস্ট রাত ৮টার দিকে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি মুজাহিদ ও সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সেখানে গিয়ে এক সেনা কর্মকর্তাকে পরামর্শ দেন, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। এ সিদ্ধান্তের পর সহযোগীদের নিয়ে মুজাহিদ আর্মি ক্যাম্পে আটকদের অমানসিক নির্যাতন করেন এবং জালাল ছাড়া বাকিদের হত্যা করা হয়।

বিচ্ছু জালাল, ফাইল ছবি

শাওন মাহমুদ, ফাইল ছবি

 

তখনকার সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধা বিচ্ছু জালাল চার দশক পর এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন।

আপিলের রায়ের পর তিনি বলেন, “এই রায়ে আমি খুশি। রায় কার্যকর হলে যদি আমার সহযোদ্ধা বদি-রুমী-আজাদ ভাই, আলতাফ মাহমুদ ভাইয়ের আত্মা শান্তি পায় তাহলে আরও খুশি হব।”

শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশে ‘যুদ্ধাপরাধী নেই, যুদ্ধাপরাধও হয়নি’ বলে মুজাহিদ দাবি করেছিলেন। পুরো বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের কাছে এটি ছিল একটি চ্যালেঞ্জ।

“এ কারণে আজকের রায়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন রায় থেকেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে, একদিন রাজাকারমুক্ত হবে।”

ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় আপিল বিভাগে বহাল রাখা হয়েছে তৃতীয় অভিযোগেও। এ অভিযোগে মুজাহিদকে দেওয়া পাঁচ বছরের কারাদণ্ড।

অভিযোগ ৩: একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুর শহরের খাবাসপুর মসজিদের সামনে থেকে রাজাকাররা ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট (রথখোলার) এলাকার মৃত রমেশ চন্দ্র নাথের ছেলে রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক করে। ফরিদপুর পুরনো সার্কিট হাউসে মুজাহিদের উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর মেজর আকরাম কোরাইশীর কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে নির্যাতনের পর মুজাহিদের নির্দেশে তাকে হত্যা করার উদ্দেশে বিহারি ক্যাম্পের উত্তর পাশে আব্দুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে বাবু নাথ সেদিন জানালার শিক ভেঙে পালিয়ে জীবন বাঁচান বলে ট্রাইব্যুনালে দেয়া সাক্ষ্যে জানান।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ মামলার প্রথম অভিযোগে জামায়াত নেতা মুজাহিদকে ফাঁসির রায় দিলেও আপিল বিভাগ তাকে খালাস দিয়েছে।

অভিযোগ ১: পাকিস্তানের বাঙালি সহযোগীদের বিরুদ্ধে একটি দৈনিকে প্রবন্ধ লেখার অপরাধে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর চামেলীবাগের বাসা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয় ইত্তেফাকের সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে। পরে তাকে হত্যা করা হয়।

অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও এ মামলার দ্বিতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে মুজাহিদের সংশ্লিষ্টতা প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে না পারায় ট্রাইব্যুনালে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রপক্ষ আপিল শুনানিতে অংশ নিয়ে আসামিপক্ষের আবেদনের বিরোধিতা করলেও তারা নিজেরা আপিল না করায় এ দুই অভিযোগ সর্বোচ্চ আদালত বিবেচনায় নেয়নি।      

অভিযোগ ২: একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ফরিদপুরের চরভদ্রাসন থানায় বৈদ্যডাঙ্গি, মাঝিডাঙ্গি ও বালাডাঙ্গি গ্রামে হিন্দুদের প্রায় সাড়ে তিনশ বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা। হামলাকারীদের গুলিতে ৫০ থেকে ৬০ জন নরনারী নিহত হন। ওই ঘটনায় ফরিদপুর শহরের হামিদ মাওলানা ছাড়াও ৮/১০ জন অবাঙালি অংশ নেন।

অভিযোগ ৪: একাত্তরের ২৬ জুলাই আলফাডাঙ্গা থেকে স্থানীয় রাজাকাররা মো. আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে আটক করে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আটক রাখে। সেখানে মুজাহিদের কাছ থেকে পাখির বিষয়ে জানতে পেরে তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। প্রায় এক মাস ৩ দিন নির্যাতনে পাখির বুক ও পিঠের হাড় ভেঙে যায়।

সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে সাংবাদিক জাহিদ রেজা নূর রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “খুশি বা বিষণ্ন হওয়ার কিছু নেই, যেটা হওয়া উচিৎ, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সেটাই ঘটল, যদিও একটা বিশাল সময়ের ব্যবধানে।”

এই শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তানের ভাষায়, যদি কেউ কোনো জাতির উপর গণহত্যা চাপিয়ে দেয়, যদি কেউ নৃশংসতাকেই জীবনের পুঁজি মনে করে, তাহলে সেই জাতি তাকে শাস্তি দিতে পারে। সেই শাস্তির ফলে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়।

“একাত্তরে তারা যে নৃশংসতা চালিয়েছে তা তো নজিরবিহীন। তারা পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলেমিশে পুরো একটা জাতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে।... এমন একটা অতীত জিইয়ে রেখে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না।”

জাহিদ রেজা নূর বলেন, এই রায়ের মধ্য দিয়ে ‘ভালো দিকে’ যাওয়ার মঞ্চ তৈরি হল; পরেও যা অনৈতিক ঘটনা ঘটেছে, তার ‘বিচারের পথ’ তৈরি হল।