নিরাপত্তার শঙ্কা নিয়েই লেখালেখিতে ব্লগাররা

চার মাসের ব্যবধানে তিন সাথী খুন হওয়ার পর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন ব্লগারদের অনেকে।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2015, 06:08 PM
Updated : 20 May 2015, 09:04 PM

কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের কেউ কেউ দেশ ছাড়ার চিন্তাও করছেন। তবে হত্যার হুমকি নিয়েও লেখালেখিতে কোনো ছাড় না দেওয়ার কথা বলেছেন তারা।

কয়েকটি খুনের প্রেক্ষাপটে ব্লগারদের নিরাপত্তায় সজাগ থাকার কথা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানালেও মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগ চোখে না পড়ার কথা জানিয়েছেন ব্লগাররা।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের নেতৃত্বে ২০১৩ সালে গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর পরই বাংলাদেশে ‘ব্লগার’ শব্দটি সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে।

তখন গণজাগরণবিরোধী হেফাজতে ইসলাম ব্লগারদের ‘নাস্তিক’ আখ্যায়িত করে আন্দোলনে নেমেছিল; যদিও ব্লগারদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্দোলনের সমর্থক যেমন রয়েছেন, তেমনি বিরোধীও আছেন।

গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর আগেই রাজধানীতে হামলার স্বীকার হয়েছিলেন ব্লগার আসিফ মহীউদ্দীন। আন্দোলন শুরুর কয়েকদিনের মাথায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে।

এরপর কয়েকজনকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়। এরপর গত ২৬ এপ্রিল বইমেলার বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় জনসমাগমের মধ্যে খুন অভিজিৎ রায়।

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের দেড় মাসের মধ্যে ঢাকার তেজগাঁওয়ে দিনদুপুরে খুন করা হয় অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে। সম্প্রতি সিলেটেও দিনদুপুরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ।

অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যা করা হয় সিলেটের এই স্থানটিতে

রাজীব ও আসিফের উপর হামলা রাতের বেলায় হলেও অভিজিতের পর দুজনকেই হত্যা করা হয় দিনের বেলা এবং এই সবগুলো হামলার ধরন একই। আর এরা সবাই ইন্টারনেটে সক্রিয় ছিলেন যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে।

ব্লগার কৌশিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুর্বৃত্তদের চাপাতির কোপে কয়েক ব্লগারের মৃত্যুর পর এখন ব্লগারদের অনেকেই নিরাপত্তহীনতায় ভুগছেন। অধিকাংশই আতঙ্কে আছেন। একজনও নিরাপদ বোধ করছেন না। কেউ দেশের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।”

ব্লগার মাহমুদুল হক মুন্সি বলেন, “ব্লগাররা এখন আতঙ্কের মধ্য দিয়েও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে যাচ্ছে। আমরা চাইছি, এই হত্যার সংস্কৃতি থেকে দেশকে বের করে নিয়ে আসতে।”

ব্লগারদের কেউ কেউ কাউকে জানিয়ে বা না জানিয়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা তো পাল্টা হামলা করতে পারি না।”

“এক ধরনের ভয় অবশ্যই কাজ করে। আমি দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য এখনও আবেদন করিনি। ভবিষ্যতে সেই রকম কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে ভেবে দেখব,” বলেন মাহমুদুল হক।

ব্লগার পারভেজ আলম বলেন, “অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। কেউ বাসা বদল করেছেন, কেউবা মোবাইল ফোন নম্বর বদল করে লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছেন।”

ব্লগারদের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্লগারদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। পুলিশের মহাপরিদর্শক, গোয়েন্দা পুলিশ, র‌্যাব তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখবেন।”

অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডস্থল টিএসসি এলাকা

সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে আইজপি এ কে এম শহীদুল হক বলেছিলেন, ব্লগারদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হবে।

তবে নিরাপত্তার বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ করেনি বলে ব্লগার পারভেজ আলম।বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে একই কথা বলেন ব্লগার বাকি বিল্লাহও।

এক ধরনের শঙ্কার মধ্যে থাকলেও লেখালেখির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আপসের পক্ষে নন অনলাইনে লেখালেখির মাধ্যমে মুক্তবুদ্ধির চর্চায় সক্রিয় এই যুবকরা।

সামহোয়ার ইন ব্লগে ‘সবাক’ নামে সক্রিয় ব্লগার বলেন, “ওরা (ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা) যে আতঙ্ক ছড়াতে চায় তাতে আমি ভীত না। আমি আতঙ্কবাদকে প্রত্যাখ্যান করি। আমৃত্যু মৌলবাদের বিপক্ষে থাকব, প্রগতির পক্ষে থাকব।”

কথিত তালিকা প্রকাশে ‘ঝুঁকি’

গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর পর সক্রিয় হেফাজতে ইসলাম তাদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে ‘নাস্তিক ব্লগার’ হিসেবে ৮৪ জনের একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়।

বিভিন্ন সংবাদপত্রে কথিত ওই তালিকা প্রকাশ ওই ব্লগারদের মৃত্যু ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। বিশেষ করে যখন হত্যাকাণ্ডের শিকারদের অধিকাংশের নামই ওই তালিকায় রয়েছে।

৮৪ জনের ওই তালিকা প্রকাশ ব্লগার হত্যাকে উস্কে দিচ্ছে বলে মনে করেন সামহোয়ার ইন ব্লগের ‘সবাক’। ওই তালিকাটি ভুয়া বলে দাবি করলেও তা প্রকাশ হওয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমালোচনাও করেন তিনি। 

“আল ইহসান পত্রিকার সম্পাদক ৮৪ জন ব্লগারের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দিয়েছিল। তা কীভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এল? নিশ্চয়ই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সার্ভ করেছে, এর সমস্ত দায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।”

লেখক আহমাদ মোস্তফা কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে তালিকাটি দেখতে পাচ্ছি, তা ২০১৩ সালের। আল বায়্যিনাত নামের একটি সংগঠনের পক্ষে থেকে সেটি জমা দেওয়া হয়েছিল।

“তবে আমার ধারণা, লিস্টটি তারা করেননি। কোনো ব্লগারের সহায়তায় তা করা হয়ে থাকতে পারে। ব্যক্তিগত রেষারেষি করে নামগুলো দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।”

এক সময় ব্লগে লেখালেখিতে সক্রিয় এই কথাসাহিত্যিক বলেন, “এটি (তালিকা) বারবার প্রচারের ফলে যাদের নাম আছে, তাদেরকে আরও বেশি ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কেউ সচেতনভাবে ফেলছেন, তা হয়ত না।”

ব্লগার বাকি বিল্লাহ বলেন, “যে তালিকা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা ব্লগারদের এক ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে। এটি আইনশৃঙ্থলা বাহিনীর নির্বুদ্ধিতার কারণেই প্রকাশ পেয়েছে।”

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমরা তো তাদের (ব্লগার) নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছি। আমরা কারও তালিকা তৈরি করিনি বা প্রকাশ করিনি।”

ওয়াশিকুর রহমানের হত্যাকাণ্ডস্থল

তবে কথিত এই তালিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে কার্যত ব্লগারদের নিরাপত্তার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতার প্রকাশ ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে।

‘সবাক’ বলেছেন, “মৌলবাদীরা ব্লগারদের তালিকা তৈরি করেছে, আর একে প্রতিষ্ঠিত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা কিভাবে আমাদের নিরাপত্তা দেবে। তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কোনো স্বদিচ্ছা নেই।”

ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লেখালেখিতে সক্রিয়দের হত্যাকাণ্ডের পেছনে জঙ্গি সংগঠনগুলো রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কয়েকটি ক্ষেত্রে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং সম্প্রতি আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার নামেও হত্যার দায়িত্ব স্বীকার করে বার্তা আসে।

গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বিভিন্ন সময়ে বলেন, “আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের স্লিপার সেলের সদস্যরা কাট আউট পদ্ধতিতে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে।”

তবে রাজীব খুন ছাড়া এই সব হত্যাকাণ্ডের অধিকাংশটিতেই খুনিদের ধরতে পারেনি পুলিশ। সাম্প্রতিক তিনটি খুনের ঘটনায় ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল থেকে দুজনকে ধরে পুলিশে দিয়েছিল জনতা, তারপর আর কোনো গ্রেপ্তার নেই।

আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই আটক হওয়া পরও ব্লগার হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ‘সবাক’।

রাজীব ও ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তারদের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, ব্লগাররা ‘নাস্তিক’ বলে নেতাদের নির্দেশে তাদের হত্যার মিশনে নেমেছিল তারা।

“যে ছেলেগুলোকে ব্রেইন ওয়াশ করে হাতে চাপাতি ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাদের বাঁচাতেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে,” বলেন ‘সবাক’।

আহমাদ মোস্তফা কামাল বলেন, সরকারের অমনোযোগ ও রাজনৈতিক বিভেদ বিভিন্ন দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের অন্যতম কারণ। এখন সরকারসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে।