শনিবার দিনভর উত্তপ্ত থাকা ওই বিদ্যালয় থেকে সব পুরুষ কর্মচারীদের সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তও জানিয়েছেন এর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ম তামিম।
তিনি বিক্ষুব্ধ অভিভাবকদের শান্ত করলেও উপাধ্যক্ষ জিন্নাতুন নেসাকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্তে পাল্টা বিক্ষোভ করে কর্মসূচি ডেকেছেন বেসরকারি এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
অভিভাবকদের হাতে অধ্যক্ষ বেলায়েত হোসেন লাঞ্ছিত হওয়ায় পাল্টা বিক্ষোভ করেছে স্কুলের কর্মচারীরাও। বিক্ষোভকারী অভিভাবকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন একদল শিক্ষার্থীও।
দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত উত্তেজনার মধ্যে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল আগামী ২৫ মে পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন হয়েছে। রোববার এর শুনানি হতে পারে।
গত ৫ মে এই বিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ভবনের শ্রমিকদের থাকার একটি কক্ষে প্রথম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার পর অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
এর মধ্যে উপাধ্যক্ষ জিন্নাতুন নেসার একটি মন্তব্যকে নারীদের জন্য অমর্যাদাকর আখ্যায়িত করে তার বিরুদ্ধেও সরব হন অভিভাবকরা।
বিক্ষোভের মুখে একটি তদন্ত কমিটি করলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অধ্যক্ষ বেলায়েত হোসেন বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চাইছেন অভিযোগ তুলে শনিবার দুপুরে বিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয় ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা।
দুপুর পৌনে ১টার দিকে স্কুলের মাঠে অবস্থান নেওয়া অভিভাবকদের সামনে আসেন অধ্যক্ষ বেলায়েত।
তিনি বলেন, “শিশু নির্যাতনের ঘটনায় যে কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তার নাম গোপাল। তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া একজন অভিভাবককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে আরেক কর্মচারী শরীফুল ইসলামকেও সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।”
এছাড়া তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি অভিভাবকদের বলেন, কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অধ্যক্ষ মাঠ ছেড়ে স্কুল ভবনের তিন তলায় নিজের কার্যালয়ে যাওয়ার পথে কয়েকজন অভিভাবক তাকে লাঞ্ছিত করেন। তাকে কিলঘুষি মারার পাশাপাশি জামাও ছিড়ে ফেলা হয়। তিনি নিচতলায় উপাধ্যক্ষের কক্ষে আশ্রয় নিলে সেই কক্ষের জানালা-দরজার কাচ ভাংচুর করেন অভিভাবকরা।
এ অবস্থায় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানসহ এলাকার বেশ কয়েকজন উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেন। ততক্ষণে পুলিশও হাজির হয় ক্যাম্পাসে।
তবে পরিস্থিতি জটিলতার দিকে মোড় নিলে উপস্থিত হন স্কুলের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ম তামিম। তিনি বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি কিছুক্ষণের জন্য শান্ত হলেও বিকাল পর্যন্ত স্কুল প্রাঙ্গণে অবস্থান নিয়ে ছিলেন অভিভাবকদের অনেকে।
অভিভাবকদের দাবির মুখে উপাধ্যক্ষ জিন্নাতুন নেসাকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণা দেন তামিম। এছাড়া অধ্যক্ষ বেলায়েতসহ সংশ্লিষ্ট অন্যদেরও অব্যাহতি দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
তবে অভিভাবকের সঙ্গে কথায় যে মন্তব্য করার কথা বলা হচ্ছে, সে ধরনের কিছু বলেননি বলে দাবি করেন জিন্নাতুন নেসা।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোন অভিভাবককে বলেছি, তা প্রমাণ করতে পারলে যে কোনো শাস্তি আমি মাথা পেতে নেব।”
এটা একবারে ‘গুজব’ এবং পরিস্থিতি ‘ঘোলাটে’ করার অপপ্রয়াস বলেও দাবি করেন জিন্নাতুন নেসা।
বেশ কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হলেও তারা স্পষ্ট করে বলতে পারেননি, ঠিক কার সঙ্গে ওই মন্তব্য করেছিলেন উপাধ্যক্ষ।
তামিম বলেন, “ঘটনার পর থেকেই কলেজে-স্কুলে নিরাপত্তার স্বার্থে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানে যত পুরুষ কর্মচারী ছিল, তাদেরকে সরিয়ে দিয়ে মহিলা কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
অভিভাবকদের পক্ষ থেকে বাথরুম সমস্যাসহ নানা অভিযোগ আসার পরিপ্রেক্ষিতে সেগুলো সংস্কারেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তামিম।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
শনিবার বিকালে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে জানান কমিটির প্রধান মুস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কমিটির একজন সদস্য ভিকটিমের বাবা। তিনি কোনোভাবেই সহযোগিতা করছেন না। তার সাথে কথা বললে তিনি এড়িয়ে যান এবং স্কুলে না এসে বিভিন্ন জায়গায় তাকে যেতে বলেন। তার স্বাক্ষর ছাড়া প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব না।”
তবে মুস্তাফিজুর বলেন, “তদন্তে যৌন হররানির অভিযোগে কাউকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষার্থী যে বর্ণনা দিয়েছে, সে ধরনের কাউকে পাওয়া যায়নি। বা সে ধরনের কেউ নেই বা ছিল না।”
গোপাল নামে একজনকে চিহ্নিত করে বরখাস্তের যে বিষয়টি অধ্যক্ষ বলেছেন, সে বিষয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য তামিম বলেন, “কর্তব্যে অবহেলার জন্য তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।”
তামিম উপাধ্যক্ষকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণা দিলে স্কুলের ভেতরে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত এককভাবে একজন ঘোষণা করতে পারেন কি না, তা নিয়েও বিক্ষোভ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়।
উপাধ্যক্ষকে অব্যাহতির ঘোষণা প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষকরা রোববার স্কুলের সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন।
এদিকে দুপুরে কয়েকজন শিক্ষার্থী সাংবাদিকদের বলেন, ছাত্রী হয়রানির ঘটনায় এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে-এই ঘটনার কোনো সত্যতা নেই। এই ঘটনার কথা তুলে স্কুলের ভেতরে বিক্ষোভ করে প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে।
গণমাধ্যমে এই মন্তব্য করায় কয়েকজন নারী অভিভাবক এগিয়ে গিয়ে ওই শিক্ষার্থীদের কয়েকজনকে চড় দেন। এক পর্যায়ে ওই অভিভাবকদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কির পর শিক্ষার্থীরা স্কুল ভবনের দোতলায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ দেখায়।
প্রয়োজনে ধর্মঘটে যাওয়ার ঘোষণাও দেয় এই শিক্ষার্থীরা। কান্নায় ভেঙে পড়া এই শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর হাত তোলার জন্য অভিভাবকের বিচারও দাবি করেন।
অন্যদিকে স্কুলের কর্মচারীরাও অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে ভবনের দোতলার একটি কক্ষে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ দেখান।
সব মিলিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ ওই বিদ্যালয়ের পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। তবে এরপর শিক্ষকদের বৈঠক করতে দেখা যায়।