দখল-বর্জনে অভিযোগবিদ্ধ তিন সিটির ভোট

কেন্দ্র দখল ও কারচুপি, সরকার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ এবং বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশনের ভোটগ্রহণ।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 April 2015, 11:50 AM
Updated : 28 April 2015, 12:17 PM

মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটির এ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ চলে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। এর পরপরই কেন্দ্রে কেন্দ্রে শুরু হয়েছে ভোট গণনা।

নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, “ভোট শেষ হয়েছে। তবে বিকাল ৪টার মধ্যে যারা কেন্দ্রে এসেছেন, তাদের ভোট নেওয়া হবে।”

এখন কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোট গণনা চলবে। কেন্দ্রভিত্তিক ফল পাওয়ার পর প্রিজাইডিং কর্মকর্তা তা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠাবেন। পরে তা সমন্বয় করে রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রাথমিক বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা করবেন।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র থেকে ঢাকা উত্তর, মহানগর নাট্যমঞ্চে ঢাকা দক্ষিণ এবং চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়াম থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তারা এই ফল ঘোষণা করবেন।

নানা অভিযোগের মধ্যেও ‘সার্বিকভাবে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে’ দাবি করে কমিশন সচিব বলেন, “কমিশনে তেমন কোনো অভিযোগ আসেনি। যদি কিছ পাওয়া যায় তা কমিশন বিবেচনা করবেন।”

তবে এ নির্বাচনে কত শতাংশ ভোট পড়েছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি নির্বাচন কমিশন।

সিরাজুল ইসলাম জানান, গোলযোগের কারণে ঢাকা দক্ষিণে বংশালের সুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়, জুরাইন আশরাফ মাস্টার আদর্শ বিদ্যালয় এবং খিলগাঁওয়ের একটি মিলিয়ে মোট তিনটি কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে ইসি ‘বাধ্য হয়েছে’।

সিটি করপোরেশনের এই নির্বাচন আইন অনুযায়ী দলীয় ভিত্তিতে না হলেও প্রার্থী ঠিক করাসহ সব কিছু কার্যত রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণেই হয়েছে।

সকালে ঢাকা সিটি কলেজ কেন্দ্র ভোটের জন্য খুলে দেওয়ার পর সেখানে প্রথমেই ভোট দেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভোটার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ভোট দেওয়ার পর বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, “জিতলে ভাল, না জিতলে আন্দোলন। আর তাদের আন্দোলন মানে তো মানুষ খুন করা।”

এরপর প্রথম ঘণ্টা মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই সব চলে। নির্বাচন কর্মকর্তারাও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটের আশা প্রকাশ করেন।

কিন্তু সকাল ৯টার পর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে।বিভিন্ন কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ জানাতে থাকেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা।

ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ‘ব্যাপক কারচুপির’ অভিযোগ এনে ভোটের চার ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ।  

ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থী মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস ও উত্তরের প্রার্থী তাবিথ আওয়ালকে পাশে নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “এটা কোনো নির্বাচন হয় নাই। এটাকে নির্বাচন বলা যায় না। ভোটবিহীন এই নির্বাচনকে আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। ... এই নির্বাচন আমরা বর্জন করি। এতে গণতন্ত্রের প্রহসন করা হয়েছে।”

আফরোজা ও তাবিথ অভিযোগ করেন, তাদের এজেন্টদের হয় কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, নয়তো বের করে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্র দখল করে সরকারসমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মনজুর আলম এর ঘণ্টাখানেক আগেই ভোট বর্জনের ঘোষণ দেন।

নেতারা অভিযোগ নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে এলেও ঢাকা বা চট্টগ্রামে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। ভোটের সময় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদেরও কেন্দ্রে পাওয়া যায়নি।

বংশালের সুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়, লক্ষ্মীবাজারে কবি নজরুল কলেজ, হাজারীবাগের জরিনা শিকদার স্কুল, উত্তর কাফরুল উচ্চ বিদ্যালয়সহ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কয়েকটি কেন্দ্রে যেসব সংঘর্ষ হয়েছে, তার মূলে ছিল কাউন্সিলর পদে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থী ও ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর সমর্থকদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা।  

এসব সংঘর্ষের জেরেই তিনটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়। পুরান ঢাকার পগজ স্কুল কেন্দ্র, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, বুলবুল ললিত কলা একাডেমি, মোহাম্মদীয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্র, ঢাকা কলেজ, বাংলাবাজার সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, ধলপুর সিটি করপোরেশন স্টাফ কোয়ার্টার উচ্চ বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বিঘ্নিত হয় বলে সংবাদ মাধ্যমের খবর।

পুরান ঢাকার নারিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লক্ষ্মীবাজারের কবি নজরুল কলেজ, চট্টগ্রামের বিএসআইআর ল্যাবরেটরি উচ্চ বিদ্যালয়, অলি আহমদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফতেয়াবাদ সিটি করপোরেশন বহুমুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও দক্ষিণ পাহাড়তলীর ফতেয়াবাদ কলেজ কেন্দ্র দখল করে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীর কর্মীদের ব্যালটে সিল মারার দৃশ্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদকরাই দেখেছেন।

তারপরও ‘শান্তিপূর্ণ পরিবেশে’ ভোটগ্রহণ হয়েছে দাবি করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নির্বাচনে ‘পরাজয় নিশ্চিত জেনে’ ভোট বর্জনের কথা বলে বিএনপি নেতৃত্ব নতুন করে আন্দোলনে নামার ‘অপচেষ্টা’ করছে।

“নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। তারা কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেখাতে পারেনি। কোনো একটি অনিয়মের তথ্য দিতে পারেনি বিএনপি।”

আর অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ শুধু বলেন, “আপনারা দেখান, আপনারা দেখান।”

নির্বাচনের আগের দিন সিইসি অভিযোগ করেছিলেন, কোনো ধরনের অনিয়ম ‘বরদাশত করা হবে না’। তবে ভোটের দুপুরে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যান।

নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কাছে সংবাদ রয়েছে- দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হচ্ছে।”       

ঢাকায় এ নির্বাচন হল মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার অন্তত আট বছর পর। সর্বশেষ অবিভক্ত ঢাকা সিটিতে ভোট হয়েছিল ২০০২ সালের এপ্রিলে। ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকাকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগের পর এটাই প্রথম নির্বাচন।

তবে চট্টগ্রামে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই নির্ধারিত সময়ে এ ভোট হল। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে এটি পঞ্চম নির্বাচন। এই সিটিতে সর্বশেষ ভোট হয়েছিল ২০১০ সালের ১৭ জুন।

৬০ লাখ ২৯ হাজার ৫৭৬ জন ভোটারের এই তিন সিটি করপোরেশনে ২৭০১টি ভোটকেন্দ্রের ১৫ হাজার ৫৪৪টি ভোটকক্ষে ভোটগ্রহণ হয়। তিন সিটিতে মেয়র পদে ৪৮ জন, সাধারণ ওয়ার্ডে ৮৯১ জন এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ২৪৯ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেন।