অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে পুলিশের বহু ব্যর্থতা: খায়রুল হক

বইমেলা ঘিরে নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে অভিজিৎ রায় খুন হওয়ার ঘটনায় পুলিশের অনেক ব্যর্থতা ধরা পড়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের চোখে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2015, 02:44 PM
Updated : 16 March 2015, 02:44 PM

এই লেখকের হত্যাকাণ্ডের সময় পুলিশের ভূমিকায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের ক্ষোভের পর এবার আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্যেও একই সুর ফুটে উঠেছে।

তার মতে, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে ব্যর্থতার জন্য পুলিশ মহাপরিদর্শকের সেদিনই পদত্যাগ করা উচিৎ ছিল।

সোমবার ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত সভায় বিচারপতি খায়রুল হক পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করে বক্তব্য দেওয়ার সময় আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও উপস্থিত ছিলেন।

রাজধানীর ধানমণ্ডির ডাব্লিওভিএ মিলনায়তনে ‘অভিজিৎ হত্যা ও চলমান সন্ত্রাস, সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শীর্ষক এই সভায় অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়ও ছিলেন।

তিনি বলেন, “আমরা সাধারণ ও অসহায় মানুষ। আমরা আগুনে পুড়ছি। আমরা বিচারালয়ের প্রতি আস্থা হারিয়ে না ফেলি।”

বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, “আপনাকে (পুলিশ) কেন এফবিআইকে ডেকে নিয়ে আসতে হবে? এফবিআই যে গ্রামার মেনে তদন্ত করে আপনাদেরও তো একই গ্রামার মেনে তদন্ত করার কথা। একই প্রশিক্ষণ, একই প্রক্রিয়া, তাদের আসার প্রয়োজন হয় কেন?

“যেমন ধরেন, অভিজিৎকে হত্যার এই ঘটনা যদি ম্যানহাটনে হত, তাহলে কী হত? ১৫ গজ দূরে বেশ কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিলো। তাদের কি উচিত ছিল না, ঘটনাস্থলে দ্রুত যাওয়া।”

“তাদের কি উচিত ছিল না, পুলিশের গাড়ি ব্যবহার করে সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। তাদের কি উচিত ছিল না, বন্যা আহমেদকে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।”

“বিদেশে পুলিশকে পুলিশ বলে না, বলে ‘ল’। বলে ল ইজ কামিং।”

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলার বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে খুন হন অভিজিৎ। মুক্তমনা ব্লগ সাইটের পরিচালক অভিজিৎ যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন। ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হুমকির মুখে ছিলেন তিনি।

ফাইল ছবি

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিকে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে নেওয়ার কথা বলে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, “তাহলে দেখেন, কতগুলো ব্যর্থতা আমার দেখতে পাচ্ছি। নির্বিকারভাবে মীর মদনের মতো, মীর জাফরের মতো দাঁড়িয়ে (পুলিশ) আছে।

“একজন সাংবাদিক জীবন তাড়াতাড়ি একটি স্কুটারে নিয়ে গেছেন। পুলিশের গাড়িগুলো কী করছিল? এর জন্য কোনো আইনের প্রয়োজন নেই। এটা একটা নর্ম, সংস্কৃতি। মানুষের প্রতি মানুষের ব্যবহার।”

“তার জন্য কৈফিয়তটা কী হল? দেখেন, মানুষ যখন মারা যায়, তখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কী পরিমাণ চিৎকার করতে পারে! তারপরও আমাদের আইন চুপ করে দাড়িয়ে, নিঃস্তব্ধ!”

“যিনি প্রধান (পুলিশ প্রধান), তার গাড়িতে দেখলাম তিনটা স্টার লাগানো। স্টার আমাদেরকে কোনো সহযোগিতা করে না। আমার মাথায় ঘিলু যেন রাস্তায় না পড়ে থাকে। আমার কাছে স্টারের দামটা এ রকম।”

“তার উচিত ছিল সেদিনই পদত্যাগ করা। ওই সংস্কৃতি আমাদের দেশে নাই। ওইটা আমরা আশাও করি না।”

ছেলেকে নিয়ে এই আলোচনায় প্রগতিশীল সব আন্দোলনে সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, “আমরা সন্ত্রাসের সংস্কৃতি নির্মাণ হতে দেখেছি। এ থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের দরকার ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।”

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, কোনো অন্যায়কারী বিচার ব্যতীত যেতে পারে না। বাংলাদেশের কেউ মনে করতে পারবে না যে, সে আইনের উর্ধ্বে। সেই বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব।

সভায় সূচনা বক্তব্যে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির সরকারের কাছে দুটি দাবি তুলে ধরেন।

অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ও অভিজিৎ রায়কে যে স্থানে হত্যা করা হয়েছে, তার সংলগ্ন চত্বরটাকে হুমায়ুন আজাদ-অভিজিৎ মোড় নামকরণের দাবি জানান তিনি।

অন্য দাবিটি হচ্ছে টিএসসি থেকে বুয়েট পর্যন্ত সড়ক হুমায়ুন আজাদ-অভিজিৎ সড়ক হিসেবে নামকরণ করার।

ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা সৈয়দ আমিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অভিজিৎ-বন্যাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সাংবাদিক জীবনকে নগদ ৩০ হাজার টাকা, প্রশংসাপত্র, বই ও ফুল দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী।

আসছেন এফবিআইয়ের আরেক সদস্য

অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড তদন্তে গোয়েন্দা পুলিশকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে এফবিআইয়ের আরেকজন সদস্য খুব শিগগির বাংলাদেশে আসছেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম সোমবার তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের একথা জানিয়ে বলেন, “সেই এক্সপার্ট এলে তদন্ত আরও ত্বরান্বিত হবে।”

অভিজিৎ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিল বলে তার হত্যাকাণ্ড তদন্তে এফবিআইয়ের সহযোগিতার প্রস্তাব এলে বাংলাদেশ সরকার তাতে সায় দেয়।

উপকমিশনার মো. মাসুদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এফবিআই থেকে আগে চারজন বাংলাদেশে এসেছিলেন। আরও একজন আসছেন। তারা সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে হত্যা রহস্য তদন্তে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে।”

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছে গোয়েন্দা ‍পুলিশ। এখন পর্যন্ত খুনিদের শনাক্ত কিংবা গ্রেপ্তার করতে পারেনি তারা। শুধু গ্রেপ্তার করা হয়েছে ফারাবী শফিউর রহমানকে, যিনি ফেইসবুকে অভিজিৎকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনিরুল বলে আসছেন, ধর্মীয় উগ্রপন্থিরাই অভিজিৎকে হত্যা করেছে বলে তাদের ধারণা।