অজয় রায়ের বক্তব্যে ফারসীম মান্নানের প্রতিক্রিয়া

অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ঘটনার দিনের এক বৈঠক নিয়ে যে সন্দেহের কথা তার বাবা অধ্যাপক অজয় রায় তুলেছেন; তার প্রতিক্রিয়ায় ওই আড্ডার আয়োজক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী বলেছেন, সেখানে অপরিচিত কেউ ছিলেন না।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2015, 03:48 PM
Updated : 14 March 2015, 04:07 PM

অজয় রায়ের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে গত বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে লেখালেখি হচ্ছে জানিয়ে শনিবার লিখিত একটি প্রতিক্রিয়া পাঠান বুয়েটের এই শিক্ষক।

ফারসীম বলেন, অভিজিতের সঙ্গে কথা বলেই তিনি বইমেলার মধ্যে ওই বৈঠকটি ঠিক করেন এবং উপস্থিতদের মধ্যে অধিকাংশই অভিজিতের চেনা ছিল, তবে তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার অচেনা হতে পারে।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলার এই বৈঠক থেকে বের হওয়ার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় খুন হন মুক্তমনা ব্লগসাইটের পরিচালক অভিজিৎ, হামলায় আহত হন তার স্ত্রী বন্যা।

ওই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক অজয় রায় বলেছেন, ফারসীম মান্নান আয়োজিত ওই বৈঠকে বেশিরভাগই ছিল তার ছেলের অচেনা। আর অচেনা ওই যুবকরাই অভিজিৎকে অনুসরণ করছিল।

অধ্যাপক অজয় রায়

অভিজিতের স্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়া বন্যার সঙ্গে কথা বলে এটা জেনেছেন বলে অজয় রায় জানান। বন্যা তাকে আরও বলেছেন, সেদিন ওই বৈঠকে অভিজিতের চেনা অন্তত দুজন উপস্থিত থাকার কথা জানানো হলেও তাদের সেখানে দেখা যায়নি।

তবে অজয় রায় বলেছেন, “আমার মনে হয়, মান্নান খুব ইনোসেন্টলি কাজটা (বৈঠক আহ্বান)  করেছে। ও যে এটার মধ্যে ইনভলবড, তা না। কিন্তু সে অনেক লোকজন ডেকেছে, অনেকে এসেছে শুনে।”

তবে অজয় রায়ের ওই বক্তব্য ধরে ইতোমধ্যেই ফেইসবুকে ‘হেইট ক্যাম্পেইনের’ আলামত পাচ্ছেন জানিয়ে ফারসীম বলেন, “তাও হাজার শুকরিয়া যে অজয় স্যার আমাকে ‘ইনোসেন্ট’ বলেছেন, নইলে এতক্ষণে প্রস্তর নিক্ষেপে সামাজিক মৃত্যু সূচিত হত।”

তিনি বলেন, “আমি শ্রদ্ধেয় অজয় স্যারকে দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, না স্যার, এই বৈঠকে অজানা অনেকে ছিলেন না, ছিলেন চেনাজানা, পরিচিত লেখক, যাদের অনেককেই অভিজিৎ রায় চিনতেন, কারণ তাদের বইসহ তিনি ছবি তুলেছেন। হয়ত সেটা বন্যা আপার কিংবা আপনার জানার কথা নয়।”

লিখিত বক্তব্যে অভিজিতের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র থেকে শুরু করে সেদিনের বৈঠকে উপস্থিত ব্যক্তি, তাদের আলোচনা, তাদের বেরিয়ে আসার ঘটনার বর্ণনা দেন ফারসীম।  

লেখালেখির সঙ্গে পরিচয় থাকলেও ২০১২ সালে বইমেলাতেই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অভিজিতের সঙ্গে প্রথম কথা হয় বলে জানান ফারসীম। আর দুজনে বুয়েট পড়েছিলেন এবং বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখি করেন বলে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।

২০১৫ সালে বাংলাদেশে আসার খবর অভিজিতের কাছেই পেয়েছিলেন ফারসীম। তিনি বলেন, এই সুযোগে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখকদের একত্র করার একটি প্রয়াস চালান তিনি।

অভিজিতের ওপর হামলার স্থান

২৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরের একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে শুনে অধিকাংশকে পাওয়ার আশায় একই দিনে আড্ডার সময় ঠিক করা হয় বলে জানান ফারসীম। ওই প্রকাশনা থেকে অভিজিৎ ও ফারসীম দুজনের বইই প্রকাশিত হয়েছে। 

“আমি ফেইসবুকে একটি মেসেজ থ্রেডে কয়েকজন লেখকসহ তিনজন সাংবাদিক এবং একজন প্রকাশককে আমন্ত্রণ জানাই। এই থ্রেডে তারাই আমন্ত্রিত ছিলেন, ২০১৫-এর মেলায় যাদের অন্তত একটি বিজ্ঞানের বই প্রকাশিত হয়েছে। এবং থ্রেডে কারা আমন্ত্রিত, সেটা কিন্তু সবাই দেখতে পাচ্ছেন। ফলে সেখানে অজানার কোনো সুযোগ নেই, কারও অজ্ঞাতেও কিছু ঘটছে না।”

ফারসীমের বক্তব্য অনুযায়ী ওই বৈঠকে ছিলেন, তার স্ত্রী, ‘স্ট্রিং থিওরি’র লেখক হিমাংশু কর, তরুণ বিজ্ঞান লেখক আবদুল গাফফার রনি, তরুণ লেখক ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষক আদনান আরিফ সালিম, জিরো টু ইনফিনিটির সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, পরিব্রাজক অণু তারেক, বুয়েট ছাত্র দীপু সরকার এবং অভিজিৎ ও বন্যা।

“আরও এক/দুইজন ছিলেন, যারা উপস্থিত লেখকদেরই বন্ধু-বান্ধব। যেহেতু খোলা আড্ডা, আসতে কারও বাধা ছিল না।”

“স্যার (অজয় রায়) বলেছেন, ওই অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে অনেক অজ্ঞাত ছেলে ছিল, কিংবা আমি অনেককে জানিয়েছি, বা অনেকের আসার কথা ছিল, কিন্তু আসেননি। ‘অনেক’ বলতে এখানে কিন্তু ওই ১০/১২ জন, যাদের মধ্যে অন্তত ৪ জনই বুয়েটিয়ান, আর অন্যদেরও নাম-পরিচয় সবই জানা। এ কয়জনই তো ছিলেন।”

শুদ্ধশ্বরের অনুষ্ঠানটি শেষ হওয়ার পরপরই ছায়াবীথি প্রকাশনীর স্টলের সামনে তেরপল বিছিয়ে আলোচিত ওই বৈঠকটি শুরু হয়।

বৈঠকের আলোচনার কথা তুলে ধরে ফারসীম বলেন, “আড্ডাটি দেরিতে শুরু হওয়ায় বেশ দ্রুতই শেষ করে দিয়েছিলাম। আমরা মূলত আমাদের নাম এবং মেলায় প্রকাশিত বইগুলোর নাম বললাম, আমি রেফারেন্সিং নিয়ে কিছু কথা বললাম।

“অভিজিৎ দাদা কিংবা বন্যা আপা তেমন কিছুই বলেননি। ফলে এভাবেই আড্ডাটি শেষ হয়। আমি ও আমার স্ত্রী যখন আড্ডা ছেড়ে উঠে আসি, আমি বন্যা আপার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি।”

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী

 

ফারসীম জানান, এরপর তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে মেলার কয়েকটি স্টলে গিয়েছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ থেকে কয়েকজন পারিবারিক বন্ধুকে নিয়ে কাঁটাবনে রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলেন।

ফারসীম বলেন, নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা থাকলে অভিজিৎ রায় নিশ্চয়ই ওই  আড্ডা এড়িয়ে যেতেন।

“আমি মনে করি, দাদা (অভিজিৎ) নিতান্ত আগ্রহ ভরেই এসেছিলেন। কারণ আমি দেখেছি, তরুণ লেখকদের সাথে মিশতে তিনি পছন্দ করতেন।”

এই প্রসঙ্গে ‘জিরো টু ইনফিনিটি’ সম্পর্কেও কথা উঠছে বলে ফারসীমের বিবৃতিতে বলা হয়। এই বিষয়েও কথা বলেন তিনি।

“এই পত্রিকায় অভিজিৎ রায়ের লেখাও ছাপা হয়েছে একাধিক। এবং তার জন্য আবদুল্লাহ আল মাহমুদকে (সম্পাদক) অনেক ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে। সেই পত্রিকাটিতে হঠাৎ করে মৌলবাদের গন্ধ পাওয়া শুরু হল গত কয়েকদিনে। ব্যাপারটা খুব আশ্চর্যের এই কারণে যে এতদিন এ রকম কোনো গন্ধ পাওয়া গেল না কেন?”

ফারসীম বলেন, তিনি এই বিজ্ঞান সাময়িকীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন প্রথম দিকে এবং সম্পাদক মাহমুদ বুয়েটে তার বিভাগেরই ছাত্র।

“প্রথম বছর দেড়েক উপদেষ্টা হিসেবে সে আমার কথা শুনেছে, কথা রেখেছে। কিন্তু পত্রিকাটির পরিসর যত বৃদ্ধি পেয়েছে, যত তার নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, তত সে আমার উপদেশ থেকে দূরে সরে গেছে।”

তবে এই ‘দূরে সরে’ যাওয়াকে বিষয়টি মাহমুদের নিজস্ব বিষয় হিসেবে দেখছেন তার শিক্ষক ফারসীম।

“তার পত্রিকা, সে কীভাবে চালাবে, এটা তাকেই ঠিক করতে হবে। একথাও ঠিক, বেশ কিছু বেঠিক মানুষের সাথে সখ্য দেখা গেছে, তবে আমি জানামাত্রই সম্পাদককে সতর্ক করেছি। তারপরও ঠিক পদক্ষেপ নেওয়া বা না নেওয়া তার দায়িত্ব। আমি তার কোনোই দায় গ্রহণ করব না।”