মুক্তমনের বাঁশুরিয়া

আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ চন্ডীদাসের এই বাণীকে ধারণ করে ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাতের ঊর্ধ্বে গিয়ে তিনি গাইছিলেন মানবতার জয়গান। মুক্ত মানসের মানুষ তৈরিতে গড়ে তুলেছিলেন অনলাইন প্লাটফর্ম- মুক্তমনা।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Feb 2015, 02:35 PM
Updated : 28 Feb 2015, 09:26 AM

ঘাতকের ছুরিতে অকালে মৃত্যু হলেও মানুষের কাছে ফুরিয়ে যাচ্ছেন না লেখক অভিজিৎ রায়: তার মৃতদেহ যাবে মেডিকেলে, শিক্ষার্থীরা শিখবে মানবদেহের বিজ্ঞান।

প্রকৌশলী অভিজিৎ যুক্তরাষ্ট্রের একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করছিলেন। এবারের বইমেলায় বেরিয়েছে তার একটি বই।

অসাম্প্রদায়িকতার লড়াই চালিয়ে আসার আদর্শ তিনি পেয়েছিলেন অধ্যাপক বাবা অজয় রায়ের কাছ থেকে। ধর্ম ব্যবসায়ী ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি লিখে গেছেন, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন ধর্মীয় কুসংস্কার

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অভিজিৎ পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি ব্লগেও লিখতেন। লেখালেখির কারণে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হুমকিও পেতে হয়েছিল তাকে।

অভিজিৎ রায়ের লেখা ডজনখানেক বইয়ের বেশিরভাগই প্রকাশ করেছে শুদ্ধস্বর। এ প্রতিষ্ঠানের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল  বলেন,“অভিজিতের লেখা তো যুক্তির কথা। পদার্থবিদ্যা, দর্শন, বস্তুবাদ নিয়ে এ রকম লেখাতো খুব বেশি লিখছেন না এখানে। আর তাকেই খুন করা হলো।”

বাঙালির ভাষার মাসে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আসেন অভিজিৎ। বইমেলা থেকে ফেরার পথেই বৃহস্পতিবার রাতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাসহ তিনি শিকার হন সন্ত্রাসী হামলার। প্রায় এক দশক আগে বইমেলার কাছে যেভাবে লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা হয়, সেভাবেই চাপাতির আঘাত এসেছে তার দেহে।

হামলার পর হুমায়ুন আজাদ কিছু দিন বেঁচে থাকলেও ফেরা হয়নি অভিজিতের। তার মৃত্যুর পর এ হত্যাকাণ্ডকে ‘বিজয়’ হিসেবে দাবি করা হয়েছে অনলাইনে, যে টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে বিশ্ব সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহ যুগিয়ে টুইট করতে দেখা গেছে এর আগে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে অভিজিৎ এসএসসি ও এইচএসসি পাসের  পর ১৯৯০ সালে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। যন্ত্র প্রকৌশলে লেখাপড়ার পর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন অটবিতে।

চাকরিরত অবস্থায় বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি করতে যান সিঙ্গাপুর। সেখানে লেখাপড়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ হয় তার। এরপর পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে।

সেখানে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করছিলেন অভিজিৎ। জিপিএস প্রযুক্তির গবেষণায় তিনি জড়িত ছিলেন বলে স্বজনরা জানিয়েছেন।

অভিজিৎ-বন্যা দম্পতির একমাত্র মেয়ে তৃষা লেখাপড়া করেন যুক্তরাষ্ট্রে। ‘এ’ লেভেল শেষ করার পর সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি।

চার বছর ধরে কোমরের ব্যথা নিয়ে বিছানায় পড়ে আছেন অভিজিতের মা। বয়সের কারণে তার অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে। প্রায় দুই বছর পর মাকে দেখতে এবং বইমেলা ঘুরে যাওয়া জন্য দেশে ফেরেন অভিজিৎ।

লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যার প্রতিবাদে শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমাবেশে অংশ নেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

তার পিসতুতো ভাই (ফুফাতো) বিষ্ণু রায় বলেন, বড় ছেলে হিসেবে অভিজিতকেই পরিবারের খরচ দিতে হতো।

ছোট ভাই অনুজিৎ রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করার পর একটি সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।

শুক্রবার দুপুরে শান্তিনগরের বাসায় গিয়ে দেখা যায়-ছেলে হারানোর শোকে মুহ্যমান অধ্যাপক অজয় রায় স্থির বসে আছেন ড্রয়িং রূমের সোফায়।

পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে সে সময় সেখানে বসে কথা বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনসহ কয়েকজন।

ওই বৈঠকের পর জানানো হয়, অভিজিতের ইচ্ছা অনুযায়ী তার মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দান করবে তার পরিবার।

এই লেখক-ব্লগারকে শ্রদ্ধা জানাতে রোববার তার মরদেহ রাখা হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে।