ময়নাতদন্ত: মানুষ হত্যায় ‘দক্ষ’ হাতের কাজ

অভিজিৎ রায়ের মাথার ডান পাশে ‘অত্যন্ত দক্ষ হাতে হিংস্রভাবে’ ধারাল অস্ত্রের তিনটি কোপ দিয়েছিল খুনি, যার ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্ম ব্যবসার বিরুদ্ধে সোচ্চার এই লেখকের মৃত্যু হয় বলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানিয়েছেন।   

কামাল তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Feb 2015, 08:11 AM
Updated : 27 Feb 2015, 01:03 PM

হামলার এই ধরন এর আগে কয়েকটি জঙ্গি হামলার কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে গলা থেকে দেহের ঊর্ধ্বভাগ অর্থাৎ মাথাই ছিল আক্রমণকারীদের লক্ষ্যবস্তু।

অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূস এবং ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারের ওপরও একই কায়দায় হামলা হয়েছিল, যেসব ঘটনায় জঙ্গিদের জড়িত থাকার বিষয়টি পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে।

বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে একুশে বইমেলা থেকে বেরিয়ে টিএসসির কাছেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন সড়কে হামলার শিকার হন মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।

তারা দুজনেই মৌলবাদবিরোধী লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রকৌশলী অভিজিৎ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে নিয়মিত লিখতেন

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় অভিজিতের। গুরুতর আহত হয়েছেন রাফিদা আহমেদ বন্যাও। 

মর্গে অভিজিৎ রায়ের লাশ

আহত রাফিদা আহমেদ বন্যা

 

শুক্রবার অভিজিতের লাশের ময়নাতদন্তের পর ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অভিজিত রায়ের মাথার পেছন দিকে ডান পাশে তিনটি গভীর আঘাতের চিহ্ন ছিল, যেগুলো করা হয়েছে চাপাতির মতো কোনো ধারাল অস্ত্র দিয়ে।

“একটি আঘত থেকে আরেকটি আঘাতের দূরত্ব আধা ইঞ্চি; সবগুলোই সমান্তরাল। ওই আঘাত এতোই মারাত্মক ছিল যে চামড়া ও হাড় কেটে একবারে মগজে পৌঁছেছে। এছাড়া পিঠে ও বাঁ চোখের ভ্রুর কাছে জখমের চিহ্ন পাওয়া গেছে।”

মূলত মাথার পেছনে তিনটি আঘাতের প্রচণ্ডতা ও অতিরিক্ত রক্তক্ষণেই অভিজিতের মৃত্যু হয়েছে বলে এই চিকিৎসকের ধারণা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এটি খুব দক্ষ হাতের কাজ। কোথায় মারলে মানুষ মারা যায়, সেটা হামলাকারীরা জানে। তারা অত্যন্ত দক্ষ ও হিংস্র ছিল। তিনটি আঘাত করেছে আধা ইঞ্চি ব্যবধানে, একটি আরেকটির ওপর পড়েনি।”

‘পরিকল্পনা, দক্ষতা আর হিংস্রতা’ ছাড়া এভাবে মানুষ হত্যা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন সোহেল মাহমুদ।  

ময়নাতদন্তের আগে লাশের সুরতহাল করেন শাহবাগ থানার এসআই সুব্রত গোলদার।

তিনি জানান, অভিজিতের মাথার পেছনে আঘাতগুলোর মধ্যে একটি তিন ইঞ্চি ও অন্যটি ছয় ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের। দুটোই প্রায় দুই ইঞ্চি গভীর।”

অভিজিৎ রায় (ফেইসবুক থেকে নেওয়া ছবি)

অভিজিৎ রায় ও রাফিদা আহমেদ বন্যা (ফেইসবুক থেকে নেওয়া ছবি)

 

এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শুক্রবার সকালে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছেন তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অজয় রায়, যাতে অজ্ঞাতপরিচয় হামলাকারীদের আসামি করা হয়েছে।

সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখালেখির জন্য অভিজিৎকে আগে থেকেই হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল জঙ্গিবাদীরা।

অজয় রায়ও সাংবাদিকদের বলেন, “আমার ছেলেকে হত্যার জন্য উগ্র জঙ্গিবাদীরাই দায়ী। এদের মদদ দিয়েছে জামায়াত।”

হত্যাকাণ্ডের পর ১৬ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তবে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে উগ্রবাদীদের পক্ষে বিভিন্ন সময় কার্যক্রম পরিচালনাকারী ফারাবী সাইফুর রহমানের নাম আলোচনায় এসেছে এ হত্যাকাণ্ডের পর।

‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে একাধিক টুইট করে এ হত্যাকাণ্ডকে ‘বিজয়’ হিসেবে দাবি করা হয়েছে।

প্রথম টুইটটি করা হয় হামলার পর রাত ১২টার দিকে, যাতে বলা হয়, “আল্লাহু আকবর.. বাংলাদেশে আজ একটি বিশাল সাফল্য এসেছে। টার্গেট ইজ ডাউন..”

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে একইভাবে চাপাতি দিয়ে লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা হয়েছিল। ওই হামলায় জঙ্গিরা জড়িত ছিল বলে পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকেও রাজধানীর মিরপুরে তার বাড়ির সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ওই হত্যাকাণ্ডেও জঙ্গিবাদীদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে।