লিটলম্যাগ চত্বর ঘিরে ‘সৃষ্টির সুখ’

একুশে গ্রন্থমেলার সার্বিক দৃশ্যই জানান দিচ্ছে গত হয়েছে শীত। বসন্তের আহ্বান চারদিকে। উষ্ণ পোশাকে দু’চার জনের দেখা মিললেও শুরুর সঙ্গে এর তফাৎ বিস্তর। তবে বসন্তের মিষ্টি হাওয়া যেন খানিকটা উষ্ণতর হয়ে উঠেছে ‘লিটলম্যাগ চত্বর’ ঘিরে।    

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Feb 2015, 02:12 AM
Updated : 18 Feb 2015, 02:12 AM

প্রতিদিনকার মতো মঙ্গলবারও দেখা গেল বাংলা একাডেমির বর্ধমান ভবনের দক্ষিণে তরুণ লেখক-লেখিকা আর তাদের ভক্তদের ভিড়। লিটলম্যাগের স্টলগুলো যে সেখানে।

গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বইমেলায় এই ‘লিটলম্যাগ চত্বরই’ হয়ে উঠে উদীয়মান কবি-সাহিত্যিকদের মিলনমেলা। নতুন লেখকরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হন, পাঠকরাও এখানে এসে দেখা পান প্রিয় লেখদের।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে সাহিত্য চর্চায় নিয়জিত প্রায় অর্ধশত ছোটকাগজ ও এগুলোর লেখকপাঠকদের সমাবেশ রয়েছে লিটলম্যাগ চত্বরে।

নতুনদের লেখা নিয়ে ছয় বছর ধরে ‘সপ্তবর্ণ’ নামে একটি সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদনা করছেন শিখা সরকার।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, নতুন লেখকরা শুরুতেই কোনো জাতীয় দৈনিকে লেখা ছাপাতে পারে না। তাদের লেখার হাত শক্তিশালী করতে লিটলম্যাগ বা ছোট কাগজ অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

“একটি লিটলম্যাগকে ঘিরে সাহিত্য আড্ডা হয়, তাদের লেখা আরও ভালো করার জন্য পরামর্শ আসে। ছড়া, কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ থেকে শুরু করে সাহিত্যের অন্যান্য বিষয়গুলোর চর্চা হয় লিটলম্যাগে।”

ছোটকাগজ ‘কৃষাণের’ সম্পাদক শাকিল হাসান জানালেন, লিটল ম্যাগাজিনের বাণিজ্যিক দিকটি গৌণ। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা এসব প্রকাশনার লেখক ও পাঠক।

কৃষাণ পত্রিকাকে ঘিরে শাহবাগ, টিএসসি, ঢাবির নাটমণ্ডল, আজিজ সুপার মার্কেট, কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজার প্রাঙ্গণসহ বিভিন্ন স্থানে নবীন লেখকদের আড্ডা হয় বলে জানান তিনি।

দুই দশক ধরে অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে এই কৃষাণ।

আমিনা শেলী সম্পাদিত ছোটকাগজ দোলকের স্টল রয়েছে লিটলম্যাগ চত্বরে। ম্যাগাজিনটি ছাড়াও নিজের প্রকাশনা থেকে আরও নয়টি গল্প, কবিতার বই মেলায় এনেছেন তিনি। এ বছর লেখিকার জলপরান বইটিও রয়েছে মেলায়।

২০০২ সাল থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ত্রৈমাসিক সাহিত্য সাময়িকী চন্দ্রধাপ। মজনু বিশদ সম্পাদিত এই পত্রিকাটির স্লোগান নতুনের জন্য আমরা নতুন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক শহীদ ইকবালের সম্পদনায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৫ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে আরেকটি সাহিত্য সাময়িকী ‘চিহ্ন’। বার্ষিক এই কাগজটিতে প্রবীণ-নবীন উভয় পক্ষের লেখকের লেখা স্থান পায়।

মেলার স্টলে রয়েছে দ্রাবিড় সৈকত সম্পাদিত অনিয়মিত লিটলম্যাগ ‘অর্বাক’। আব্দুল মান্নান স্বপন সম্পাদিত ‘ধমনি’, যা প্রকাশিত হয় দুই মাস পর পর।

অপেশাদার লেখকদের সমাগম হিসেবে দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে বার্ষিক সাময়িকী ‘দ্রষ্টব্য’। কামরুল হুদা পথিক সম্পাদিত এই সাহিত্য সাময়িকীটিকে ঘিরে রয়েছেন লেখক ঋষি এস্তেবানসহ একঝাঁক তরুণ।

ঋষি এস্তেবান জানান, শুধু দ্রষ্টব্যই নয়, ‘করাতকল’, ‘চালচিত্র’ আরও ‍দুটি অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা নিয়ে তাদের আড্ডা জমে।

লিটলম্যাগ চত্বরের মাঠেই তরুণ কবি শাফি সমুদ্রের সঙ্গে আড্ডায় মেতেছিল মঈন, শাকিল, আহসানসহ ৮/১০ জন কিশোর। নিজেদের লেখা নিয়ে নতুন একটি লিটলম্যাগ প্রকাশ করার পরিকল্পনা নিয়ে কথা হচ্ছিল তাদের।

জানতে চাইলে মঈন বলেন, “আমাদের লেখার কাজ প্রায় শেষ।  ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ ও মুদ্রণ বিষয়ে ভাইয়ার (শাফি) পরামর্শ নিতে এসেছি।”

শাফি সমুদ্রের মতে, ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম না থাকলেও ৯০ এর দশকে জনপ্রিয়তা পাওয়া লিটলম্যাগের মূল লেখক অপেশাদার তরুণ-তরুণীরা। তবে ইদানিং অনেকে দামি বিজ্ঞাপন ছাপছেন এবং এক ধরনের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে লিটলম্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ তার।

বই মেলায় শালুক, গল্পকথা, শাহবাগ, নিসর্গ, উষালোকে, শিড়দাঁড়, শব্দতরীসহ আরও অসংখ্য লিটলম্যাগ রয়েছে। এসব সহিত্য পত্রিকাকে ঘিরে রয়েছে তরুণ লেখক-লেখিকাদের বড় সমাবেশ।

রোদেলা প্রকাশনী নিয়ে প্রতিক্রিয়া

নীতি বহির্ভূত বই প্রকাশের কারণে একদিন আগে উদ্যান প্রান্তে রোদেলা পাবলিকেশন্স বন্ধ করে দেওয়া নিয়েও নিজেদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন লেখক, পাঠক ও দর্শনার্থীরা। অনেকের আবার বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক মত দিতে অস্বীকৃতি আছে।

কারো কাছে ব্যাপারটি স্পর্শকাতর হলেও অনেকে বলছেন কোনো নির্দিষ্ট বই নিয়ে আপত্তি থাকলে কেবল সেটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেত।

মঙ্গলবার বই মেলায় এসেছিলেন খ্যতিমান কবি আল মাহমুদ। অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলা একাডেমিসহ কয়েকটি স্টল ঘুরেছেন তিনি।

আগের দিনের রোদেলা প্রকাশনা নিয়ে সাংবাদিকরা কবির মতও জানতে চেয়েছিলেন। তবে এনিয়ে মত দিতে রাজি হননি তিনি।

স্টল বন্ধের প্রতিবাদে এদিকে সন্ধ্যায় টিএসটিতে মেলার মূল প্রবেশপথে লেখক-প্রকাশক-পাঠক-জনতার ব্যানারে বিক্ষোভ দেখিয়েছে একদল যুবক।

লেখক পারভেজ আলম, প্রকাশক রবিন আহমেদ, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, লেখক জাকির তালুকদার, সাবেক ছাত্রনেতা মানবেন্দ্র দেবসহ অন্যান্যরা সেখানে বক্তব্য দেন।

বক্তরা বলেন, হেফাজতে ইসলামের হুমকির কাছে মাথানত করে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ রোদেলা প্রকাশনী বন্ধ করেছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রোদেলার স্টল খুলে না দিলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালের পদত্যাগের দাবি তোলা হবে।

মেলার নতুন বই

মেলার ১৭তম দিনে ১২০টি নতুন বই এসেছে। এছাড়া মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে ১১টি নতুন বইয়ের।

বিকেলে মেলার মূল মঞ্চে প্রয়াত শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। শিল্পী রফিকুন নবী, মফিদুল হক, মইনুদ্দীন খালেদ ও সাজ্জাদ শরিফ আলোচনায় অংশ নেন। সভাপতিত্ব করেন শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী।