‘পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য’ কাজ করবেন বিচারপতি সিনহা

সব মতের আইনজীবীদের উপস্থিতিতে সংবর্ধিত হয়ে নতুন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, তিনি কাজ করবেন বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Jan 2015, 08:20 AM
Updated : 18 Jan 2015, 05:32 PM

সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের দায়িত্বগ্রহণ ও বিদায়ের দিনে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক আইনজীবীরা উপস্থিত না থাকলেও রোববার উচ্চ আদালতের ১ নম্বর বিচারকক্ষে বিচারপতি এস কে সিনহার সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ছিল কানায় কানায় পূর্ণ।

নতুন প্রধান বিচারপতি বলেন, “নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগের ব্যাপারে আমরা স্বাধীন।...

“আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নিম্ন আদালতের ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে পারব, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়া নিম্ন আদালতে বদলি ও বাধ্যতামূলক অবসর হতে দেব না।”

নিম্ন আদালতে নিয়োগ পরীক্ষার খাতা দেখেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা।

“সেখানে চুল পরিমাণ ফাঁক নেই।... বিচার বিভাগে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি, হবেও না। আমরা একটি সিস্টেম ডেভেলপ করেছি।”

২০০৭ সালে বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হলেও নিম্ন আদালতের কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে। আইনজীবীরা এসব বিষয় প্রধান বিচারপতির নজরে আনলে এভাবেই তার জবাব দেন তিনি। 

নিম্ন আদালতে বিচারক নিয়োগে সরকার বা জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই বলেও উল্লেখ করেন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি সিনহা।

ভারতে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এ বিষয়ে ‘ফেয়ার আরও কিছু’ করা যায় কি-না, আলোচনার মাধ্যমে তিনি তা দেখবেন।

সবার সঙ্গে পরামর্শ করেই উচ্চ আদালতে বেঞ্চ গঠনের সিদ্ধান্ত হবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেন। 

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে বিচারপতি সিনহাই প্রথম অমুসলিম ও আদিবাসী, যিনি সর্বোচ্চ আদালতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

শনিবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছ থেকে শপথ নেওয়ার পর বিচারপতি সিনহা দায়িত্ব বুঝে নেন।

সব ধরনের সন্ত্রাস দমনের আহ্বান

সব ধরনের সন্ত্রাস দমনে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে এক্ষেত্রে অপরাধীদের ন্যূনতম সময়ে শাস্তি নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন বিচারপতি এস কে সিনহা।

তিনি বলেন, “আমরা জানি, অধিকাংশ সময় উন্মত্ত সন্ত্রাসী কার্যক্রমের শিকার হয় নিষ্পাপ সাধারণ মানুষ। সকল ধরনের সন্ত্রাস দমনে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

“সত্যিকারের অপরাধীদের ন্যূনতম সময়ে শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা না করা গেলে সন্ত্রাস দমন করা যাবে না।”

শপথ নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন

অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রমাণ ও উপকরণ সংগ্রহে বাংলাদেশের তদন্ত সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়াতেও জোর দেন তিনি। 

“সম্প্রতি কিছু স্পর্শকাতর মামলায় এটা আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রয়োজনীয় প্রমাণ ও উপকরণের অভাবে দণ্ডিতের দণ্ড বহাল রাখা যাচ্ছে না। যেগুলো তদন্ত পর্যায়ে সংগ্রহ করার কথা ছিল।”

“প্রমাণ সংগ্রহের পরিবর্তে ফৌজদারি তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে পত্রিকায় খবর প্রকাশে অধিক প্রবণতা আমি লক্ষ্য করেছি,” বলেন প্রধান বিচারপতি।

আদালতে বিচারের আগে কাউকে অপরাধী হিসাবে পরিচয় করিয়ে না দিতেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

সুপ্রিম কোর্টে সম্প্রতি বোমা-পিস্তল পাওয়ার প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তার স্বার্থে সর্বোচ্চ আদালতের প্রবেশপথে বিধিনিষেধ আরোপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি।

ঔপনিবেশিক আইন বদলের আহ্বান

ব্রিটিশ আমলে করা ঔপনিবেশিক আইনগুলো পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক সমাজের উপযোগী করার আহ্বান জানিয়েছেন নতুন প্রধান বিচারপতি।

“আমরা এমন একটি পরিবর্তনশীল জটিল সমাজে বাস করি, যেখানে মানুষের আচরণ ও জীবনযাত্রায় বিজ্ঞান প্রযুক্তির প্রভাব রয়েছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের বিরোধ ও অপরাধের ঘটনা ঘটছে।”

“আইন প্রত্নতত্ত্বের মতো তুলে রাখার, প্রশংসা করা বা সেলফে রাখার বিষয় নয়। বরং এটা এমন একটা গাছের মতো যার মূল ইতিহাসে প্রোথিত, যা সময়ের সঙ্গে নতুন পত্রপল্লবে সুশোভিত হয় এবং মরা ডালপালা ঝেড়ে ফেলে।”

জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়ার পর পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর

“এই ডিজিটাল সময়ে আমরা বিচার বিভাগের প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করতে পারব না। যতক্ষণ টেকসই ও সাশ্রয়ী তথ্য প্রযুক্তিকে এখানে সমন্বিত না করব।”

আদালত ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগের ওপর জোর দিয়ে বিচারিক ও প্রশাসনিক কাজ করতে বিশেষায়িত সফটওয়ার চালু করার কথা বলেন তিনি।

“এই সব লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমাদের বিদ্যমান সেকেলে আইন ও বিধিগুলোকে নিয়ে চলতে পারব না। যার মধ্যে দেওয়ানি কার্য‌বিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন, দণ্ডবিধি, আর্মস আইন প্রভৃতি। খুঁটিনাটি পরীক্ষার পর এই আইনগুলো করা উচিত।”

“আমরা জানি, এই সব আইন ঔপনিবেশিক আমলে করা হয়েছে। এই কারণে এই দেশের বিদ্যামান আইনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিফলন নেই। এর মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক জাতি হিসাবে আমরা ৪৩ বছর অতিক্রম করে ফেলেছি।

“কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রয়োজনীয় আইনগুলোকে গণতন্ত্রিক জাতির উপযোগী করে তুলতে পারি নাই। সুতরাং আমি এই জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”

স্বপ্ন ছিল না বিচারক হওয়ার

বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে একদিন আগে শপথ নিলেও বিচারক হওয়ার স্বপ্ন ছিল না আদিবাসী সম্প্রদায়ে জন্ম নেওয়া সুরেন্দ্র কুমার সিনহার।

বাংলাদেশের প্রথম অমুসলিম প্রধান বিচারপতির বাবা তাকে শিক্ষক বানাতে চেয়েছিলেন।

এস কে সিনহার জন্ম মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের আলীনগর ইউনিয়নের তিলকপুর গ্রামে ১৯৫১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর ১৯৭৪ সালে তিনি সিলেট বারে আইনজীবী হিসাবে তালিকাভুক্ত হন।

সেখানে তিনি ফৌজদারি মামলায় বিশেষজ্ঞ আইনজীবী সোলেমান রাজা চৌধুরী ও দেওয়ানি মামলার বিশেষজ্ঞ আইনজীবী গোলাম কিবরিয়া চৌধুরীর জুনিয়র হিসাবে কাজ করেন।

১৯৭৮ সালে তিনি হাই কোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসাবে তালিকাভুক্ত হন। উচ্চ আদালতে উপমহাদেশের বিখ্যাত আইনজীবী এসআর পালের জুনিয়র হিসাবে কাজ শুরু করেন।

বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, “আমার ব্যাকগ্রাউন্ডেই আমি কখনোই এই আদালতের বিচারক হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি। কিন্তু এসআর পালের জুনিয়র হিসাবে যোগ দেওয়ার পর আমার অনুধাবন ক্ষমতা ও জীবন সম্পূর্ণ বদলে যায়।”

পরে হাই কোর্টে তিনি বিচারক হিসাবে নিয়োগ পান ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর। আপিল বিভাগে আসেন ২০০৯ সালের ১৬ জুলাই।

জাতীয় স্মৃতিসৌধে সহকর্মীদের সঙ্গে

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আপিল বিভাগের যে বেঞ্চ বাতিল করেছিল, এস কে সিনহা ছিলেন তার অন্যতম সদস্য। এছাড়া ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় দেওয়া বেঞ্চেও সদস্য হিসাবে ছিলেন তিনি।

প্রধান বিচারপতির বাবা ললিত মোহন সিনহা একজন শিক্ষক ছিলেন। তার নামে একটি পাঠাগার রয়েছে কমলগঞ্জে।

শিক্ষক বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে এস কে সিনহাও পেশা হিসাবে শিক্ষকতাকেই গ্রহণ করবে।

“কিন্তু আইনজীবী হতে আমার সুদৃঢ় সংকল্পের কারণে আইনের ডিগ্রি নেওয়ার পর আমি সিলেট বারে যোগ দিই।”

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, প্রধান বিচারপতি হিসেবে এস কে সিনহার নিয়োগে বাংলাদেশে ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রতিফলন হয়েছে।

“বর্তমান বিশ্বে সভ্যতার মাপকাঠি হিসাবে ধর্ম নিরপেক্ষতাও বিবেচিত হয়। আপনার নিয়োগে সংবিধানের মূলস্তম্ভ অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার বাস্তব প্রতিফলন ঘটল।”

পাকিস্তানে ভগবান দাসকে অস্থায়ী বিচারক হিসাবে নিয়োগের বিরোধিতা করে আন্দোলনের কথা তুলে ধরে মাহবুবে আলম বলেন, বাংলাদেশে সবাই এটাকে স্বাগত জানিয়েছে।

প্রধান বিচারপতি তার বক্তব্যে এই প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি এস এইচ কাপালিয়ার একটি কথা উদ্ধৃত করেন।

এস এইচ কাপালিয়া বলেছিলেন, ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের জনগোষ্ঠীর পার্সি সম্প্রদায়ের একজন ভারতের প্রধান বিচারপতি হয়েছে। যেটা ভারতের প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে সত্য নয়।

“বিচারপতি কাপালিয়ার এই বক্তব্য ভারতের সব প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে সত্য নয়,” বলেন বিচারপতি এস কে সিনহা।