রাতভর রুদ্ধশ্বাস অভিযান

রাজধানীর শাহজাহানপুরে পরিত্যক্ত একটি গভীর নলকূপের পাইপে চার বছর বয়সী এক শিশুর আটকা পড়ার খবরে রাতভর রুদ্ধশ্বাস অভিযানেও তার কোনো খোঁজ মেলেনি।

ফয়সাল আতিকও শেখ আবদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Dec 2014, 01:52 PM
Updated : 28 Dec 2014, 03:03 AM

১৪ ইঞ্চি ব্যাসের ওই পাইপে আড়াইশ মিটার গভীর পর্যন্ত ক্যামেরা নামিয়ে ঘণ্টাখানেক তল্লাশি চালানোর পর শনিবার ভোররাতে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান জানান, শিশুটির কোনো সন্ধান তারা পাননি।  

এসময় (রাত পৌনে ৩টা) ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও একই কথা বলেন।

তিনি বলেন, “আমার মনে হল, এখানে কেউ নাই। তারপরও সেখানে যে ডেবরিস (আবর্জনা) আছে, তা তুলে দেখা হবে। ফায়ার সার্ভিসের ডিজি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবেন।  তবে আমি নিশ্চিত, এখানে কোনো মানুষ নেই।”

প্রথম দফায় পাইপের আড়াইশ মিটার গভীর পর্যন্ত ক্যামেরা নামিয়ে একটি কাপড়, স্যান্ডেল, কর্কশিটের টুকরো, টিকটিকি ও কাগজের মতো অবয়ব দেখা যায়। দ্বিতীয় দফায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় সার্ভেইলেন্স আইপি ক্যামেরা নামিয়েও কোনো শিশুর দেহের অস্তিত্বের খোঁজ পাননি উদ্ধারকর্মীরা।  

ফলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনতার মধ্যে দেখা দেয় বিভ্রান্তি। শিশুটি আদৌ সেখানে পড়ে গিয়েছিল কি না, অনুসন্ধানের দ্বাদশ ঘণ্টায় সে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেন কেউ কেউ।

যদি সেখানে কোনো শিশু নাই থাকে, তাহলে ‘ভেতরে আটকা পড়া শিশুটির সঙ্গে’ সন্ধ্যায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কথা বলা কিংবা তাকে দুধ বা জুস পাঠানোর বিষয়গুলো নিয়েও গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দেয়।

এসব প্রশ্নের উত্তরে আলী আহমেদ খান কেবল জানিয়েছেন, তারা আরও অনুসন্ধান করবেন। শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে অভিযান শেষ করবেন না।

ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ছবি: নয়ন কুমার/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনি মাঠের পাশে পরিত্যক্ত একটি গভীর নলকূপের পাইপে জিহাদ নামের চার বছর বয়সী এক শিশুর পড়ে যাওয়ার খবরে শুক্রবার বিকালে সেখানে ছুটে যান গণমাধ্যমকর্মীরা।

খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করে। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আরও কয়েকটি ইউনিট।

শিশুটির বাবা নাসির ফকির মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নৈশ প্রহরী। ওই কলোনির ৪১ নম্বর বিল্ডিংয়ে তাদের বাসা।

নাসির সাংবাদিকদের জানান, বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে খেলতে জিহাদ ওই গর্তে পড়ে যায় বলে এক প্রতিবেশী তাদের জানান।

স্থানীয় গৃহবধূ রাহেলা ও আরিফ নামের এক কিশোরও সাংবাদিকদের একই কথা বলেন।

এরই মধ্যে উদ্ধারকর্মীদের বরাত দিয়ে টেলিভশনের সরাসরি সম্প্রচারে বলা হয়, ওপর থেকে চিৎকার করে শিশুটির সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। সন্ধ্যায় সেখানে আলোর ব্যবস্থা করা হয় এবং দড়িতে টর্চ লাইট বেঁধে শিশুটির জন্য ভেতরে পাঠানো হয় ফলের রস।

জিহাদকে বাঁচিয়ে রাখতে পাইপ দিয়ে অক্সিজেন পাঠানোরও ব্যবস্থা হয়। চার দফা দড়ি নামিয়ে তাকে তুলে আনার চেষ্টা করেন উদ্ধারকর্মীরা। জিহাদ দুইবার সেই দড়ি ধরতে পেরেছেন বলেও উদ্ধারকর্মীদের ধারণা হয়। তাদের সেই বক্তব্য গণমাধ্যমে এলে উত্তেজনা আরও বাড়ে। 

শাহজাহানপুরের ওই ঘটনাস্থল ততক্ষণে পুরো দেশের নজর কেড়ে নিয়েছে। টান টান উত্তেজনা নিয়ে টেলিভিশনে অভূতপূর্ব এই উদ্ধার অভিযান দেখছে সারা দেশের মানুষ।

পাশের একটি এলাকায় ওয়াজে আসা হাজার খানেক মানুষও উদ্ধার অভিযান দেখতে সেখানে ভিড় করেন। কয়েক হাজার উৎসুক জনতাকে সামলাতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে।

সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলোতেও তখন আলোচনার কেন্দ্রে এই উদ্ধার অভিযান। সবার কথায় জিহাদের জন্য শুভকামনা, উৎকণ্ঠা, ক্ষোভ অথবা ‘হবে কি হবে না’র দ্বন্দ্ব।

চার বছরের জিহাদ। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

জিহাদের বাবা নাসির ফকির। ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

 

দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে সবার ছোট জিহাদকে নিয়ে শঙ্কায় তার মা খাদিজা বেগম ততোক্ষণে প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। প্রতিবেশীরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তাদের বাড়িতেও ছিল উৎসুক জনতার ভিড়।

চারবার দড়ি নামিয়ে ফল না পাওয়ায় পঞ্চম দফায় একটি বস্তা বেঁধে নিচে দড়ি ফেলা হয়, যাতে শিশুটি তাতে উঠে পড়লে টেনে তোলা যায়।

কিন্তু তাতেও কোনো ফল না পেয়ে উদ্ধার অভিযানে কিছুটা হতাশা নেমে আসে।

স্থানীয়রা জানান, রেলওয়ে কলোনির পশে মাঠের ফাঁকা জায়গায় ওই গভীর নলকূপ দিয়ে ঠিকমতো পানি না ওঠায় ১০ মাস আগে তা পরিত্যক্ত করা হয়। খানিকটা দূরে পানি উত্তোলনের জন্য বসানো হচ্ছে আরেকটি পাম্প।

রেল কর্তৃপক্ষই এসব পাম্পের দায়িত্বে রয়েছে বলে ওয়াসার পক্ষ থেকে জানানো হয়।

ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এটি রেলওয়ের নিজস্ব পাম্প। তবে গঠন ওয়াসার পাম্পের মতোই।

এই গভীর নলকূপে উপরের দিকে রয়েছে ১৪ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ। তার নিচে ‘সাবমারসিবল’ পাম্প। পাইপের এই পুরোভাগকে বলা হয় ‘হাউজিং’।

পাম্পের নিচ থেকে তিন ইঞ্চি ব্যাসের আরেকটি সরু পাইপ আরও গভীরে চলে গেছে। পাম্পের ওপরে হাউজিং এলাকাতেই জিহাদ আটকে রয়েছে ধারণা করে উদ্ধার অভিযান চলে।

অভিযানের নেতৃত্বে থাকা ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ সাংবাদিকদের জানান, ১৪ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের মাঝে তিন ইঞ্চির আরেকটি পাইপ থাকায় ভেতরে লোক নামানো সম্ভব হচ্ছে না। ক্রেইন এনে ওই পাইপ সরিয়ে পরের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।   

ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

 

এরপর মাঠের ফটক ভেঙে ক্রেইন এনে সরু পাইপ টেনে তুলে কেটে কেটে সরিয়ে নেওয়া হয় হয়। শেষ পর্যন্ত ১৬টি টুকরোতে  প্রায় ৩০০ ফুট পাইপ সরিয়ে বাইরের পাইপের মুখ পরিষ্কার করতে রাত ১১টা পার হয়ে যায়।

এরপর শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য সেখানে ক্যামেরা ও আলোসহ বশির আহমেদ নামের এক স্বেচ্ছাসেবীকে নামানোর কথা ভাবা হলেও পরে নিরাপত্তার খাতিরে তা বাতিল করা হয়।

ফায়ার সার্ভিসের স্বেচ্ছাসেবী বশির এর আগে রানা প্লাজার উদ্ধার অভিযানেও অংশ নিয়েছিলেন।

এরই মধ্যে বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একটি প্রতিনিধি দল তুলনামূলভাবে সরু নতুন একটি পাইপ ঢুকিয়ে শিশুটিকে উদ্ধারের একটি বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন।

তাদের সঙ্গে কথা বলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান সাংবাদিকদের বলেন, বুয়েটের প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে তারা চেষ্টা চালিয়ে দেখতে চান। পাইপ কেটে ওই ‘ক্যাচার’ বানানোর কাজও শুরু হয় বলে তিনি জানান।

এদিকে নলকূপের মুখ বন্ধ না রাখায় নতুন গভীর নলকূপ স্থাপনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স এস আর হাউসকে এরইমধ্যে কালো তালিকাভুক্ত করে রেল কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ের জ্যেষ্ঠ উপসহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমকে করা হয় বরখাস্ত।

ঢাকার পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ, ওয়াসার  মহাপরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক পরিস্থিতি দেখতে ঘটনাস্থলে আসেন।

ছবি: নয়ন কুমার/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

পাইপে নামানো ক্যামেরায় ধরা দৃশ্য। ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

এরপর দুটি ক্যামেরা সেখানে পৌঁছালে সেগুলো পাইপের নামিয়ে শুরু হয় শিশুটির অবস্থান সনাক্ত করার চেষ্টা। জিহাদকে উদ্ধার করা সম্ভব হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা সম্বলিত একটি অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে প্রস্তুত রাখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। 

দীর্ঘ সময় ক্যামেরা দিয়ে অনুসন্ধান চালানোর পাইপে কোনো শিশুর দেহ না থাকার কথা জানান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। এরপর বিভ্রান্তি ও নানা প্রশ্নের মধ্যে উদ্ধার অভিযান অনেকটাই ঝুলে যায়। 

এদিকে নানা ধরনের প্রশ্ন দেখা দেওয়ায় রাত ৩টার পর জিহাদের বাবা নাছিরউদ্দিনকে আটক করে নিয়ে যায় শাহজাহানপুর থানা পুলিশ।

ওই থানার ওয়্যারলেস অপারেটর আনিসুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জিহাদের বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসা হয়েছিল। মিনিট পনের কথা বলার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।”

[প্রতিবেদনটি তৈরি করতে সহযোগিতা করেছেন ম্ঈনুল হক চৌধুরী ও সালাউদ্দিন ওয়াহেদ প্রীতম]