রায় শুনে থ

কাঁপুনি নিয়ে বিচারকের দিকে স্থির তাকিয়ে থেকে রায় শুনছিলেন একাত্তরে হত্যা, ধর্ষণসহ ১৬টি অপরাধের অভিযোগের মুখে থাকা জাতীয় পার্টির সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Dec 2014, 04:53 PM
Updated : 23 Dec 2014, 06:07 PM

তবে প্রারম্ভিক বক্তব্যের পর বিচারক ওবায়দুল হাসান যখন একে একে তাকে দোষী ঘোষণা করতে থাকেন, শরীরের কাঁপুনি নিয়ন্ত্রণ করে তাতেই ক্রমে স্থির হয়ে পড়েন সাবেক মন্ত্রী কায়সার। এক পর্যায়ে লাঠিতে ভর দিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাঁ দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকেন তিনি।

মঙ্গলবার সকালে লাঠিতে ভর করে ট্রাইব্যুনালের এজলাসে আসেন কায়সার, সময় তখন ১০টা ৫০ মিনিট। এর ১০ মিনিটের মাথায় এজলাসে ওঠেন তিন বিচারক।

লাঠিতে হালকা ভর দিয়ে চেয়ারে বসে থাকা সত্তরোর্ধ্ব কায়সারের হাত বেশ কাঁপছিল। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবির ওপরে সোয়েটার, তার ওপর ধূসর রঙের ব্লেজার পরা ছিলেন তিনি।

চার দশক পর যুদ্ধাপরাধের বিচার ও আলোচ্য মামলার প্রেক্ষাপট নিয়ে বিচারক যখন কথা বলছিলেন, কায়সার তখন বিহ্বল মুখে বড় বড় চোখে সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন।

তবে সময় গড়াতেই তার চেহারায় দেখা দিতে থাকে আতঙ্কের ছাপ। টানা তিনটি অপরাধের বর্ণনা দিয়ে এগুলোতে বিচারক যখন তাকে দোষী সাব্যস্ত করেন, ধীরে ধীরে বিচারকদের মঞ্চ থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বাঁ দিকে মুখ করে থাকেন কায়সার।

তৃতীয় অপরাধটি ছিল হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরের কৃষ্ণনগর গ্রামে ৫৫টি ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া এবং অহিদ পাঠান, চেরাগ আলী, জনাব আলী ও মধু সুইপারকে গুলি করে হত্যা। রায়ে এই অভিযোগটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত বলে ঘোষণা করা হয়।

তৃতীয় অভিযোগে কায়সারকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

হবিগঞ্জের পূর্ব মাধবপুরে আব্দুস সাত্তার, লালু মিয়া ও বরকত আলীকে হত্যা এবং কদম আলীকে জখম করার দায়ে গঠিত চতুর্থ অভিযোগে কায়সারকে খালাস দেয় আদালত। তবে এর পরে পঞ্চম থেকে চতুর্দশ পর্যন্ত সবগুলো অভিযোগে তাকে দোষী বলে ঘোষণা করে আদালত। এসব অভিযোগের মধ্যে হত্যা, ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে আগুন, নির্যাতনসহ অন্যান্য জঘন্য অপরাধ রয়েছে।

এক ঘণ্টারও বেশি সময় নিয়ে আদালত যখন কায়সারকে ‘গিল্টি’ বলে ঘোষণা করছিলেন তখন তার চেহারায় হতাশার ছাপ পড়তে থাকে। হাতের কাঁপুনিকে নিয়ন্ত্রণ এনে তখন মুখ ভার করে স্থির হয়ে পড়েন তিনি।

হবিগঞ্জের মাধবপুরে শালবন রঘুনন্দ পাহাড় এলাকায় নাজিম উদ্দিন নামের এক ব্যক্তিকে অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতনের পঞ্চদশ অভিযোগটি থেকে খালাস পেলেও মুক্তি মেলেনি শতাধিক ব্যক্তিকে গণহত্যার দায় থেকে।

সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে (১৫ নভেম্বর) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাটপাড়া থানার দাউরা, নিশ্চিন্তপুর, গুটমা, বুরুঙ্গা, চিতনা, নূরপুর, ফুলপুর, জেঠাগ্রাম, পাঠানিশা, কুলিতুণ্ডা, আন্দ্রাবহ, তিলপাড়া, কমলপুর, গঙ্গানগর, বাঘি, শ্যামপুর, কুয়ারপুর, নোয়াগাঁও, কুণ্ডা, লক্ষ্মীপুর, করগ্রাম গ্রামের ১০৮ জন গ্রামবাসীকে হত্যার ষোড়শ অভিযোগে দোষী হন কায়সার। সর্বশেষ এই অভিযোগেও মৃত্যুদণ্ডের রায় শুনতে হয় তাকে।

রায় ঘোষণা শেষে বিচারকরা চলে যাওয়ার পরে নিজের পায়ে একাই দাঁড়িয়ে যান সৈয়দ মো. কায়সার। এসময় দুই ভাই ও ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথাও বলেন তিনি। পরে দুইজন পুলিশ দুই পাশ থেকে ধরে তাকে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে যায়।

গতবছর ১৫ মে আদালতের নির্দেশের পরদিন রাতে গ্রেপ্তার করা হয় মুসলিম লীগের সাবেক নেতা কায়সারকে। এরপর তাকে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

২১ মে হাসপাতাল থেকে কায়সারকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এদিন ট্রাইব্যুনালে ঢোকার সময় পুলিশের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটছিলেন কায়সার।

তার জামিন আবেদনের শুনানির জন্য প্রসিকিউশন সময় চাইলে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-২ পরদিন শুনানির দিন ঠিক করে কায়সারকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।

পরে কারা কর্তৃপক্ষ কায়সারের স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিবেদন দাখিল করার পরে ৫ অগাস্ট তাকে ছয় শর্তে  জামিন দেয় ট্রাইব্যুনাল। জামিনের পরে বনানীতে নিজের ছেলের বাসা থেকে আদালতে হাজিরা দিতেন এই যুদ্ধাপরাধী।