শরীরের কয়েকটি জায়গায় পরিষ্কার দাগ এখনও ভীষণ স্পষ্ট, জন্মদাগ হিসাবেই এখন বলতে হয় তাকে। জন্মের পর তো আর তার পক্ষে এটা কীসের ক্ষত বোঝা সম্ভব হয়নি; পরে কৈশোরে জানতে পারলেন, দাগের উৎপত্তি পাকিস্তানি সেনাদের বেয়নেটের খোঁচা।
Published : 08 Dec 2014, 09:24 PM
বেয়নেটের আঘাত নিয়েই জন্ম তার। পাকিস্তানি সেনারা ধর্ষণের পর, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে তার মাকে। খোঁচার দাগে মায়ের গর্ভের শিশুর দেহেও কেটে গেছে।
কামিজের একপাশটা তুলে দেখালেন ঘাড়ে, পিঠে, বাহুতে বড় বড় ক্ষত।
মৃত পড়ে ছিল মা। অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া শিশুটিকে বিশেষ ব্যবস্থায় পৃথিবীর আলোতে নিয়ে আসেন যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে থাকা কানাডিয়ান চিকিৎসক হালকে ফেরি। তার স্থান হয় পুরান ঢাকার মাদার তেরিজা হোমে। সেখান থেকে কানাডিয়ান এক দম্পতি ৬ মাস বয়সে তাকে দত্তক সন্তান হিসাবে নিয়ে যান। নাম হয় তার মনোয়ারা ক্লার্ক।
একেবারেই বাংলা না জানা মনোয়ারা মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর দেশে এসেছেন, কেবলমাত্র জন্ম সনদ নিতে। এই সনদের জন্য এত আকুলতা তার আরো ৮/১০ বছর আগেও ছিল না। পারষ্পরিক বোঝাপড়ায় ফিনল্যাণ্ডের এক নাগরিককে বিয়ে করার পর যখন তার মেয়ে জন্মাল আর মেয়েটি হলো অটিস্টিক, তারপরই স্বামী বলতে থাকলো- অটিস্টিক বেবির জন্য তুমিই দায়ী।
“কারণ, আমার পরিবারের পরিচয় আছে। তোমার কোন পরিচয় নেই-মা নেই, বাবা নেই-তুমি একটা ওয়ার বেবি আর সেকারণেই তোমার বেবিটা অটিস্টিক হয়েছে।”
গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে আড্ডায়, ভীষণ উচ্ছ্বল আর প্রাণবন্ত হাসির মাঝে বিষণ্ন হয়ে উঠছিলেন মনোয়ারা, আবার দ্রুত সামলে নিচ্ছিলেন।
বলেন, “হ্যাঁ, আমার মা নেই, বাবা নেই-আমি জানি না তারা কারা বা আমার জন্ম কোথায়, কিন্তু এখন আমি একটা জিনিসই চাই: আমার জন্ম সনদ। আমার জন্ম সনদের জন্যই আমি বাংলাদেশে এসেছি।
“আই অ্যাম হিয়ার ফর মাই আইডেন্টিটি। আই অ্যাম হিয়ার ফর মাই ফ্যামিলি। বার্থ সার্টিফিকেট উইল মেইক মি মোর কনফিডেন্ট।”
গত ৩০ নভেম্বর ঢাকায় এসেছেন মনোয়ারা ক্লার্ক। এরমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গিয়েছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিধ্বস্ত-ধর্ষণের শিকার নারীদের ছবিগুলো নিজের মোবাইল ফোনে ধরে রেখেছেন।
সেইসব ছবি মোবাইল থেকে দেখাচ্ছেন আর প্রতিবেদককে বলছেন, “দ্যাখো, আমার মা-ও তো এরকম ছিল হয়তো। এসব ফটোগ্রাফ দেখেছি আর কেঁদেছি। তারপর নিজেকে আবার শক্ত করেছি। মা আমার কে ছিল জানি না, কিন্তু বাংলাদেশ তো আমার মা।”
১৯৭২ সালের সমাজকল্যাণ অধিপ্তরের অফিসিয়াল কাগজে দেখা যায়, ইন্টার কান্ট্রি চাইল্ড অ্যাডপশন প্রজেক্টের অধীনে তাকে ক্লার্ক দম্পতির কাছে দেয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সহায়তায় পুরান ঢাকার মাদার তেরিজা হোমে যান তার জন্ম সনদ সংগ্রহের জন্য। সেটা সংগ্রহ করে সিটি কর্পোরেশনে জমা দেয়া হবে। দ্রুতই তিনি পেতে যাচ্ছেন তার জন্ম সনদ।
সিটি কর্পোরেশনও একটা আনুষ্ঠানিকতা করতে যাচ্ছেন বলে জানালেন তার সঙ্গে থাকা বাংলাদেশি কাজী চপল, যার সাথে ফেইসবুকে যোগাযোগের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন।
নিজভূমে আসার খুশি আড়াল করতে পারেনি তার বেদনা আর যন্ত্রণা। এক ফোঁটা বাংলা না জানা মনোয়ারা ইংরেজিতে বলে যাচ্ছিলেন, “ক্লার্ক পরিবারে বড় হতে হতে বুঝতে পারি চারপাশের সাদা চামড়ার শিশুরা আমার সাথে মিশতে চাইতো না, কথা বলতে চায় না। কারণ আমি ব্রাউন, আমি সাদা চামড়া না।
“যেই ক্লার্ক পরিবার আমাকে অ্যাডপ্ট করেছিল, তারা স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে গেল। আমি থেকে গেলাম মিসেস ক্লার্কের কাছে আর তিনি যে কী অসহনীয় ছিলেন। ১২/১৩ বছরের দিকে তারা আবার আমাকে অন্য একটি পরিবারে দিয়ে দিলেন।
“আমি আবার নতুন করে আরেকটা পরিবারের সদস্য হলাম। মার্গারেট নিকেল নামের সেই নারীর কাছ থেকেই পেয়েছি ভালোবাসা, পড়াশুনার সুযোগ। এখনো তার সাথে যোগাযোগ আছে।”
“মাই হোল লাইফ ইজ ফুল নেগলিজেন্সিস, আপস অ্যান্ড ডাউন, ব্রোকেন রিলেশনশিপ, অল দিজ মেইড মি সো স্যাড। সো স্যাড। আই জাস্ট ওয়ান্ট মাই বার্থ সার্টিফিকেট। আই ওয়ান্ট টু লিভ মাই লাইফ অ্যাজ বাংলাদেশি।”
কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ভ্যাঙ্কুভারে মনোয়ারা একটি ওল্ডহোমে নার্সিংয়ের কাজ করেন। নার্সিংয়ে পড়াশুনা করতে করতেই তিনি চাকরি জুগিয়ে ফেলেন ২৩ বছর বয়সে। ২৭ বছর বয়সে বাড়িও করেন। ৭ বছরের সংসার জীবন কাটানোর পর নিত্যদিনকার অপমান আর সইতে না পেরে নিজেই ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছেন।
মনোয়ারা হঠাৎ বলা শুরু করেন, “জানো আমি একটা কুকুরের বাচ্চা পেয়েছি বসুন্ধরা সিটির সামনে। রাস্তার কুকুর। আমি সেটা নিয়ে এখন আমার কাছে রেখেছি। ওটা কানাডায় নিয়ে যেতে চাই। আমার বাংলাদেশের অফিসিয়াল পরিচয়, এই বাংলাদেশের পাপ্পি আর আমার মেয়ে-এই নিয়েই আমি, আমার বেঁচে থাকা, আমার সুখি হয়ে ওঠা। আমার এই স্ট্রাগলিং লাইফের এইটা আমার শান্তি”।