মুক্ত হাওয়া শিস দিচ্ছে ছিটমহলে

শিগগির ছিটমহল বিনিময়ের সম্ভাবনায় টানা পঁয়ষট্টি বছরের প্রায় বন্দি জীবন থেকে মুক্তির আশায় প্রহর গুনছেন বাংলাদেশ ও ভারতের ভেতরে ছিটমহলের অধিবাসীরা।

আনিসুর রহমানআনিসুর রহমানআহসান হাবীব, সাইফুল আলম ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Dec 2014, 04:56 PM
Updated : 6 Dec 2014, 08:43 PM

ছিটমহল বিনিময়ে দুদেশের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি কার্যকরে ভারতের সংবিধান সংশোধন বিল রাজ্যসভায় ওঠার আগে দীর্ঘ দিন থেকে এর বিরোধিতাকারী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার কুচবিহারে এক জনসভায় অবস্থান বদলের ঘোষণা দেন।

ভারতীয় বাংলা দৈনিক আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে সমাবেশে মমতার বক্তব্য তুলে ধরা হয়।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “দুই বাংলার মধ্যে সব সময় মধুর সম্পর্ক ছিল, আছে, থাকবে। ছিটমহলের বাসিন্দাদের দুর্দশার কথা আমি জানি। স্বাধীনতার পর থেকে তাদের জুটছে লাঞ্ছনা, বঞ্চনা। যারা বাংলাদেশের বাসিন্দা তারা বাংলাদেশে ফিরে যেতে চায়। যারা ভারতের, তারা ভারতে থাকতে চায়।  দুদেশের মধুর সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে এই কাজ সম্পন্ন হোক, এটা আমরা চাই। ছিটমহল বিনিময় আমরা চাই।”

রাজ্যের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দ্রুত কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দেওয়া হবে বলে সমাবেশে জানান মমতা।

কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট সরকারের আমলে মমতার আপত্তিতেই ছিটমহলবাসীদের এতোদিনের অপেক্ষার অবসান হয়নি।

এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের উদ্যোগের পর মমতার কাছ থেকে ইতিবাচক ঘোষণা পেয়ে তাদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইছে।

তাদের আশা, শিগগিরই স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকরে সংবিধান সংশোধন করে ভারত সরকার তাদের বন্দি জীবনের অবসান ঘটাবে।

ছিটমহলের এসব বাসিন্দা এখন কার্যত কোনো দেশেরই নাগরিক নন, তারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকারগুলো থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। তাদের কোনো ভোটাধিকার নেই।

ছিটমহল বিনিময় হলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কুচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলায় বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অধিবাসীরা ভারতের নাগরিক হবেন। আর বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহলের বাসিন্দারা বাংলাদেশের নাগরিক হবেন।

মমতার সমর্থন ঘোষণার পর কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও পঞ্চগড়ে থাকা ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দারা উল্লাসে মেতে ওঠেন।  খুশিতে তারা মিষ্টি বিতরণ করেন। কোথাও খণ্ড খণ্ড আনন্দ মিছিল হয়েছে। এছাড়া জুমার নামাজের সময় শুকরিয়া মোনাজাতও করা হয়।

এসব জেলার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত:

কুড়িগ্রাম

শুক্রবার কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলা সদরের ভারতের ১৫০ নম্বর ছিটমহল দাসিয়ারছড়ায় সরেজমিনে গিয়ে এমন উল্লাস চোখে পড়ে।  কথা হয় গৃহবধূ রাহেলা বেগম (৪৫), আলেকজন বিবি (৫০), শিক্ষার্থী আয়শা সিদ্দিকা ও কৃষক এছহাক আলীসহ (৭০) কয়েকজনের সঙ্গে।

তারা বলেন, ছিটমহল বিনিময় হলে তারা বাংলাদেশের নাগরিক হবেন। তাদের আর মিথ্যা পরিচয় দিয়ে জীবনযাপন করতে হবে না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ যাবতীয় সুযোগ তারা বৈধভাবেই গ্রহণ করতে পারবেন।

গংগারহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী আয়শা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছিটমহলে জন্ম হওয়ায় মিথ্যা পরিচয়ে পড়ালেখা করতে হচ্ছে। নিরাপত্তা নেই, নেই কোনো নাগরিক অধিকার।

“ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের নাগরিক হতে চাই। তখন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার  আমূল পরিবর্তন হবে।”

নিজের খুশির কথা প্রকাশ করে কৃষক এছহাক বলেন, ধান ও পাটসহ কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য সার, কীটনাশক ও তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে আগে নানা সমস্যায় পড়তে হত।  বাংলাদেশের নাগরিক হলে সেই বিড়ম্বনা আর হবে না।

৬৫ বছরের বন্দি জীবনের কথা বললেন কৃষক জহুরুল হক, বাচ্চু, শাহআলম ও ব্যবসায়ী জোবাইদুল।

তারা বললেন, “স্বাধীনতার মুক্তির স্বাদ কী- তা কেবল খাঁচায় বন্দি পাখিই বোঝে। আর হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারি আমরা। ভারত কিংবা বাংলাদেশ- কোনো দেশেরই নাগরিক সুবিধা আমাদের ভাগ্যে জোটে না। এনিয়ে দীর্ঘ দিন লাগাতার আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছি।

এ ফসল ঘরে উঠলে আর চাওয়ার কিছু নাই। আমাদের সন্তানদের একটা পরিচয় হবে, তারা গর্ববোধ করবে।”

পঞ্চগড়

পঞ্চগড়ের ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে শুক্রবার দিনভর উল্লাস চলে। মুক্তির আনন্দে খণ্ড খণ্ড আনন্দ মিছিল হয়।  চলে মিষ্টি মুখ ও শুকরিয়া মোনাজাত।

দুপুরে বোদা উপজেলার পুটিমারি ছিটমহলে গিয়ে দেখা যায়, পাশের গারাতি ছিটমহলের নাগরিক কমিটির নেতা ও বেশ কিছু অধিবাসী সমবেত হয়ে একে অপরের সঙ্গে করমর্দন ও কোলাকুলি করেন।

গারাতি ছিটমহলের নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান মফিজার রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘদিনের বন্দি দশা থেকে এবার বুঝি আমারদের মুক্তি মিলছে। ভারতের কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে আমরা সে ইঙ্গিতই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এজন্যই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পুটিমারিতে এসেছি।”

পুটিমারি ছিটমহলের নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান তসলিম উদ্দিন বলেন, “বাপ-দাদারা অস্বাভাবিক জীবন নিয়েই পরপারে চলে গেছেন। আমরাও অনিশ্চিত জীবনযাপন করছি। শেষ বয়সে এসে অন্তত বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে যেন নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি-এটুকুই আমাদের চাওয়া।”

শালবাড়ি কাজলদিঘী বেহুলাডাঙ্গা ছিটমহলের নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, “পঞ্চগড়ে অবস্থিত ভারতীয় ৩৬টি ছিটমহলেই কমবেশি আনন্দের ঢেউ লেগেছে। আমরা দ্রুত এই আনন্দকে স্থায়ী রূপ দিতে ভারত সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।”

লালমনিরহাট

জেলার বাঁশপচাই, ভোটবাড়ি ও ভিতরকুটিসহ একাধিক ছিটমহলের বাসিন্দারা ছিটমহল বিনিময়ের খবরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।

তারা জানান, ভারতের ছিটমহলের বাসিন্দা হলেও তারা বাংলাদেশের হাট-বাজার ব্যবহার করছেন, এখানকার স্কুল-কলেজে তাদের পড়াশোনা চলছে। কিন্তু অন্য কোনো সুয়োগ পাচ্ছে না; চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এ বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ ইউনিটের সভাপতি মইনুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ছিটমহলগুলোতে মৌলিক অধিকার ও মানবিকতার  জয় হয়েছে। মমতার সম্মতিতে এখন এটি ভারতের লোকসভায় পাশ হওয়া সময়ের অপেক্ষামাত্র।

“আশা করছি এটি দ্রুত পাশ হবে। পাশ হলে আমাদের ছিটমহলের মানুষেরা অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি পাবে। অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করছি স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণের।”

মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির ভারতীয় চ্যাপ্টারের সহ-সাধারণ সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মমতার ঘোষণার পর ভারত-বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহলে এখন আনন্দের জোয়ার বইছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও আন্তরিক। স্থলসীমান্ত চুক্তি বিল সংসদে পাশ হওয়াটা এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

“ইতিমধ্যে ছিটমহল পুনর্বাসনের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ৩০৮ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করেছে। কাজেই বিনিময়ের পর ছিটমহলবাসীদের তেমন কোনো সমস্যা হবে না।”

কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, পঞ্চগড় ও লালমনিরহাট জেলায় ভারতের ১১১টি ছিটমহল রয়েছে। ১৭ হাজার ১৫৮ হাজার একর জায়গা নিয়ে এসব ছিটমহলে ৩৭ হাজার ৩৬৯ মানুষের বসবাস।

অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার ও জলপাইগুড়িতে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে। সাত হাজার ১১০ একর আয়তনের এসব ছিটমহলে বসবাস করছে ১৪ হাজার ২১৫ জন মানুষ।

এগুলোর মধ্যে লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি, কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি, নীলফামারী জেলায় ৪টি ভারতীয় ছিটমহল রয়েছে।

১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত স্থল সীমান্ত চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল।  চুক্তি বাস্তবায়নে ২০১১ সালে তৎকালীন ইউপিএ জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় একটি প্রটোকল সই হয়।

প্রটোকলটি কার্যকরে ভারতের সংবিধান সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছিল কংগ্রেস সরকার। এজন্য পার্লামেন্টে একটি বিল তোলা হলে বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা সে সময়ের বিরোধী দল বিজেপির সঙ্গে মমতার তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতায় তা ঝুলে যায়।

তবে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির অবস্থান পরিবর্তন হয়।

গত সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক পার্লামেন্টারি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সংবিধান সংশোধনের বিলের খসড়াটির অনুমোদন দেওয়া হয়। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের দুই প্রতিনিধি সুগত বসু ও মুমতাজ সংঘমিত্রা চুক্তির পক্ষে সায় দেন।

বুধবার কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়েছে, ৬৫ বছর ধরে ঝুলে থাকা সমস্যাটির সমাধানে সম্মতি জানিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে রাজ্য সরকার।