ক্ষুব্ধ বার্গম্যানের বউ সারা হোসেন

আদালত অবমাননার দায়ে সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে দণ্ড দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার স্ত্রী ব্যারিস্টার সারা হোসেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Dec 2014, 04:31 PM
Updated : 2 Dec 2014, 04:34 PM

মঙ্গলবার রায়ের পরে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি বলেন, ‍‍“ট্রাইব্যুনালের এ রায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর চরম আঘাত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি হচ্ছে স্বাধীনভাবে মুক্ত চিন্তার চর্চা করা,এবং ভিন্নমত সহ্য করে নেওয়া। ভিন্নমত যদি থাকে,থাকলেও তার বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত। খুবই দুঃখের বিষয়,এই আদালতের আজকের এই রায় বাকস্বাধীনতাকে কোনোভাবেই সংরক্ষণ করে না, বরঞ্চ বাক স্বাধীনতকে রুদ্ধ করে।”

ব্যক্তিগত ব্লগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে মন্তব্য করায় মঙ্গলবার ডেভিড বার্গম্যানকে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতে দাঁড়িয়ে থাকার দণ্ডের পাশাপাশি পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করে। জরিমানার টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তাকে সাত দিনের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।

রায়ের পর বার্গম্যানের স্ত্রী সারা হোসেন বলেন, “যারা এখানে সংবাদকর্মী আছে তাদের প্রথমেই এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা উচিৎ, সাংবাদিকরা কিছু বলতে পারবে না, কিছু করতে পারবে না,  অবমাননার আইন দিয়ে এভাবে রুদ্ধ করে রাখা হবে, আপিলের সুযোগ থাকবে না,যেটা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত না। এ সব কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশকে পৃথিবীর কাছে ভালো চোখে দেখায় না।

‍“সব কিছু যে কোর্টের আইন দিয়ে বেঁধে দেওয়া তা সাংবিধানিক কি না? অবমাননা হবে এবং এখানে আপিলের সুযোগ থাকবে না,  প্রশ্ন তোলার জায়গা থাকবে না-সেটায় বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে অধিকারটুকু আদায় করতে পারবে কি না তা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

ডেভিড বার্গম্যানের বাংলাদেশে অবস্থান করা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, “এটা ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার না। কারো নাগরিকত্ব দেখা-না দেখা, এটি তাদের কাজ না। তারা যদি হুমকি দিতে চায়, বাংলাদেশি একজন নাগরিকের স্বামী,  তার অধিকার থাকবে না এদেশে থাকার, এদেশে কথা বলার,  তাহলে আমি এ ব্যাপারে চরম, চরম, চরম আপত্তি জানাচ্ছি।

“মনে হচ্ছে এদেশে দুই ধরনের নাগরিক আছে। একদল যারা অন্য দেশের নাগরিককে বিয়ে করতে পারবে, ঢাল-তলোয়ার পরে আছে।  উচ্চতর পর্যায়ে তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন, যা ইচ্ছা তাই বলতে পারবেন, তাতে কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু যারা সরকারের কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তুলবে তাদের আক্রমণ করা হবে। এ সরকারের কোনো কাজ নিয়ে সমালোচনা করলেই- সেটা উনি (ডেভিড বার্গম্যান) হোক, আমি হোক, অন্য যে কেউ হোক… আপনারা সবাই ভালো বুঝছেন তার উপরে কেন আক্রমণ আসছে।”

বার্গম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগটি ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের ছিল না উল্লেখ করে সারা বলেন, “কোর্ট একটা রায় দিয়েছে, কিন্তু কোর্ট এ রায় কিসের ভিত্তিতে দিয়েছেন। প্রসিকিউশনের কোনো আবেদনের ভিত্তিতে দেয়নি। তৃতীয় একটি পক্ষের আবেদনে এ রায় দিয়েছে। ওই তৃতীয় পক্ষ কারা? কারা তাদের এখানে পাঠিয়েছে? কেন তারা এখানে এসছেন? আপনারা কেন এ প্রশ্নগুলো করছেন না?”

এসময় একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন,কারা তাদের পাঠিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

জবাবে সারা বলেন, “আমার মনে হচ্ছে এর পিছনে কোনো একটা কারণ আছে। আপনারা খোঁজ করেন, আপনারা সংবাদকর্মী, আপনাদের তদন্ত করে বের করা উচিত যে কেন মনে করা হচ্ছে যে, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো একটি প্রশ্ন তোলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাস আছে। সেটা নিয়ে কেন কথা বলা যাবে না?”

এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন,আপনি কি মনে করেন বাক স্বাধীনতার চর্চার মানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা?

জবাবে সারা হোসেন বলেন, “৩০ লাখ, তিন লাখ বলা বা ইতিহাস বিকৃত করার কথা এখানে আসছে না। ৩০ লাখ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এমন অনেককে হাতের কাছে পাওয়া যায়নি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, কিন্তু রায় হয়নি।  হাতের মধ্যে একজনকে পাওয়া গেছে সেজন্যই কি রায় দেয়া হয়েছে?”

আরেক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইমোশন কি আপনার চেয়ে আমার কম আছে? আপনি কি মনে করেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যাপারটা কি শুধু আপনার কাছেই থাকবে,আমার কাছে থাকবে না?

“মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তার (বার্গম্যানের)  কাজ আছে। সেইগুলো আমরা কোর্টে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে দাখিলও করেছি। বিচারের পক্ষে সে বলে গেছে সবসময়,কখনোই সে বলেনি বিচার হবে না। এ প্রশ্ন তোলা হলে সেটা আমি মনে করি, অন্যায় হয়েছে। তারপরও যে রায় দেওয়া হয়েছে সেটা আমরা পুরোটা দেখে নেই…তারপর পরে সিদ্ধান্ত নেব।

‍“আমি আবারো বলছি, আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আমি ২০ বছর আন্দোলন করেছি, মিছিল করে এসেছি। সেখানে আমার স্বামীকে কেন দেশ থেকে উৎখাত করা হবে? সেটা কোর্টের এখতিয়ারের বিষয়ও না, তা নিয়ে তারা কেন মন্তব্য করবে? এটা আমার কাছে একটা রহস্য মনে হয়। আমি ঘোর আপত্তি জানাচ্ছি যে, কেন এমন করে ভিকটিমাইজ করা হচ্ছে?”

মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে এ বিষয়ে সারা হোসেনের কোনো সন্দেহ আছে কি না- তা এক সাংবাদিক  জানতে চাইলে তিনি আবারো বলেন, “আমরা ৪৩ বছরধরে বলে এসেছি,অনেকে আরো অনেক কিছু বলেছেন,লিখেছেন। যদি অন্য কারো লেখা নিজের লেখার মধ্যে উল্লেখ করা হয় তাহলে কেন সেটা অপরাধ হবে সেটা আমার বোধগম্য নয়।

“মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যার বিষয়ে এখনো পৃথিবীতে অনেক জায়গায় আছে, অনেক একাডেমিক জার্নালে লেখা আছে। সেগুলো আপনারাও সংগ্রহ করতে পারেন,আপনারাও পড়তে পারেন।

“আমার মনে হয় আপনারা যদি আজকে ডেভিড বার্গম্যানের শাস্তিকে সঠিক মনে করেন তাহলে হার্ভার্ডের প্রফেসর আছেন, ভারতীয় সাংবাদিকরা আছেন  যারা এ নিয়ে লিখেছেন, তাদের সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত।”